ভয়াবহ লোকসানের কারণে সীতাকুণ্ডে নির্মিত দেশের একমাত্র জাহাজভাঙা শিল্পে এখন চরম দুর্দিন যাচ্ছে। গত ছয় মাস ধরে লোহার দাম কমতে থাকায় ইয়ার্ড-মালিকেরা বিপুল পরিমাণ লোকসানের স্বীকার হয়েছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ অবস্থা চলতে থাকায় বহু শিল্পপতি এখন ব্যাংকঋণে জর্জরিত। আর বর্তমান বাজারমূল্যে লোহা বিক্রি করে লাভের কোনো সম্ভাবনা না থাকায় অনেকেই স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ করে দিয়েছেন। এতে অর্ধশত ইয়ার্ড জাহাজশূন্য হয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে গত ছয় মাস ধরে স্থানীয় বাজারে লোহার দাম অবিশ্বাস্য হারে কমে গেছে। এতে প্রতি টন লোহা ৩৮ হাজার টাকায় কিনে ৩৫-৩৬ হাজার টাকায় বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন মালিকেরা। ফলে টনপ্রতি তাদের লোকসান যাচ্ছে দুই-তিন হাজার টাকা। এই হিসেবে একটি ১০ হাজার টনের স্ক্র্যাপ জাহাজ ভেঙে বিক্রি করলে ২ কোটি টাকার বেশি লোকসান হচ্ছে আমদানিকারকদের। সংশ্লিষ্টরা জানান, ছয় মাসে একটি ইয়ার্ডে দুই থেকে তিনটি জাহাজও আমদানি হয়। এতে এ সময়ে কোনো কোনো মালিক ৬ থেকে ৯ কোটি টাকা পর্যন্ত লোকসান দিয়েছেন। এ ছাড়া বর্ষায় নির্মাণকাজ আগের তুলনায় কম হওয়ায় সহসা বাজারদর বৃদ্ধির কোনো লক্ষণ দেখছেন না তারা। ফলে নতুন করে লোকসান এড়াতে বহু মালিক এখন স্ক্র্যাপ জাহাজ আমদানি বন্ধ রেখেছেন। এ মুহূর্তে ৫০ শতাংশ ইয়ার্ডেই কোনো জাহাজ নেই বলে বিএসবিএ নেতৃবৃন্দ জানান। এতে বেকার হয়ে পড়েছে হাজার হাজার শ্রমিক। সরেজমিনে জাহাজভাঙা ইয়ার্ড এলাকা ঘুরে মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। উপজেলার বারো আউলিয়া সাগর উপকূলবর্তী রাইজিং শিপব্রেকিংয়ের মালিক আসলাম চৌধুরী এফসিএ জানান, রাজনৈতিক অস্থিরতা, দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে শিপব্রেকিং সেক্টরে এই অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে লোহার দাম ঠিক থাকলে দেশে দাম কম থাকায় ক্রয়মূল্যের চেয়েও কম দামে স্ক্র্যাপ লোহা বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। তিনি জানান, জাহাজ ক্রয়, আমদানি খরচ, এআইটি ও শ্রমিক মজুরিসহ বর্তমানে প্রতি টন লোহার ক্রয়মূল্য পড়ছে প্রায় ৩৮ হাজার টাকা। অথচ বিক্রি হয়েছে ৩৫-৩৬ হাজার টাকায়। এই শিল্প উদ্যোক্তা আরও বলেন, এভাবে লোকসান হতে থাকায় বাজারে টিকে থাকাই কষ্টকর হয়ে পড়েছে। বাধ্য হয়ে অনেক মালিক এখন জাহাজ আনছেন না। তার পার্শ্ববর্তী বেশ কয়েকটি ইয়ার্ডে বর্তমানে কার্যক্রম বন্ধ।
এ ইয়ার্ডের শ্রমিকেরা জানান, অনেক দিন ধরে শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের খারাপ সময় যাচ্ছে। মালিকেরা যে দামে মাল কিনছেন, তার থেকেও কম বিক্রি হচ্ছে। এর মধ্যে অনেক ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে গেছে। শোনা যাচ্ছে, আরও অনেক ইয়ার্ড বন্ধ হয়ে যাবে। যদি জাহাজভাঙা উঠোন বন্ধ হয়ে যায়, তবে কী করে নিজে বাঁচবেন এবং পরিবারের অন্যদের বাঁচাবেন, তা ভেবেই দিশেহারা শ্রমিকেরা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে, সীতাকুণ্ডের ভাটিয়ারী থেকে কুমিরা সাগর উপকূলে নির্মিত অনেকগুলো ইয়ার্ডেই বর্তমানে কোনো জাহাজ নেই। বাংলাদেশ শিপব্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএসবিএ) সভাপতি হেফাজতুর রহমান জাহাজভাঙা শিল্পে ঘোর দুর্দিনের কথা স্বীকার করে বলেন, জাহাজভাঙা শিল্পে লোকসানের সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। এত বেশি লোকসান হয়েছে যে ঘুরে দাঁড়ানোই মুশকিল। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে বেশি দামে কিনে দেশে কম দামে বিক্রি করায় কোটি কোটি টাকার লোকসান গুনছেন মালিকেরা। এ কারণে বর্তমানে ১০৩টি শিপব্রেকিং ইয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেকই বন্ধ।
এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি স্থানীয় সংসদ সদস্য এ বি এম আবুল কাসেম বলেন, ‘এখানে ১০৩টি ইয়ার্ড দেশের যাবতীয় লোহার জোগান দিয়ে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে ব্যাপক অবদান রাখছে। এখান থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করছে সরকার। কিন্তু এখন ব্যাংকগুলো এ শিল্পকে আগের মতো ঋণ না দেওয়ায় এবং লোহার বাজার ধসের কারণে এ শিল্পে খুবই দুঃসময় বিরাজ করছে। তাই আমরা এ শিল্পকে রক্ষায় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছি। ইতিমধ্যে এআইটির বিষয় নিয়েও আমরা কাজ শুরু করেছি। এ ছাড়া দেশের অন্যতম এ শিল্পকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের আরও যা যা করণীয়, আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা দেব।’
শেয়ার করুনঃ