পয়লা আগস্ট দৈনিক ‘প্রথম আলো’র প্রথম পাতায় গাজীপুরের একটি কারখানায় আগুনের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ এমন ছবি দেখে অভ্যস্ত হলেও গাজীপুরের লিবাস গার্মেন্টসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাটি ছিল একটু আলাদা। এই কারখানায় শর্ট সার্কিট বা অন্য কোনো কারণে আগুন লাগেনি। বোনাস কম দেওয়ার অভিযোগে আগুন দিয়েছে এই কারখানারই শ্রমিকেরা। পত্রিকায় প্রকাশিত এই ছবির বিশেষত্ব বা আলাদা তাৎপর্য এখানেই।
রানা প্লাজার কারণে এমনিতেই বিশ্বজুড়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত মারাত্মক ভাবমূর্তি-সংকটে আছে, বিশেষ করে বিশ্বের বড় বড় পোশাক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের পোশাক খাতের পরিবেশ নিয়ে উদ্বিগ্ন। রানা প্লাজা বা তাজরীন ফ্যাশনের শোক এবং ক্ষত এখনো শ্রমিক এবং দেশবাসীর মনে স্পষ্ট, যা কাটিয়ে উঠতে দীর্ঘ সময় লাগবে। এর মধ্যে লিবাস কারখানার মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি পোশাক খাতকে সংকটের গভীরে নিমজ্জিত করবে। শ্রমিক যেখানে নিজেই নিজ প্রতিষ্ঠানে আগুন দিচ্ছে, সেখানে সার্বিকভাবে খাতটির নিরাপত্তার প্রশ্নটি দেশে-বিদেশে বড় হয়ে ওঠা খুবই স্বাভাবিক।
রানা প্লাজায় প্রায় দেড় হাজার শ্রমিকের করুণ প্রাণহানির বিনিময়ে পোশাকশিল্প শ্রমিকদের জন্য তড়িঘড়ি করে ন্যূনতম মজুরি বোর্ড করা হয়েছে। শ্রম আইন সংশোধন করা হয়েছে। ঈদের আগেই বেতন-বোনাস পরিশোধের জন্য সরকার ও বিজিএমইএর পক্ষ থেকে কারখানামালিকদের সতর্ক করা হয়েছে। এর পরও লিবাস কারখানার ঘটনা এমন ইঙ্গিতই দেয় যে খাতটিতে শ্রমিকদের ভয়াবহ ক্ষোভ আছে, যা প্রশমিত করতে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। আর উদ্যোগটা আসতে হবে কারখানামালিকদের পক্ষ থেকেই। সরকার শুধু প্রয়োজনীয় সমর্থন জুগিয়ে যাবে।
এমন ঘটনার নিন্দা জানিয়েছে শ্রমিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনগুলো। টেলিফোনে সম্মিলিত গার্মেন্টস ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার ‘সময় বিচিত্রা’কে বলেন, ‘শ্রমিকদের কাছ থেকে এ ধরনের ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ভাঙচুর করে, আগুন দিয়ে শ্রমিকের কোনো লাভ হয় না, বরং ক্ষতিই হয়। তা ছাড়া সহিংসতা দাবি আদায়ের হাতিয়ার হওয়া উচিত নয়। এমন কোনো কর্মকাণ্ডকে আমরা সমর্থন করি না। এ কারণেই আমরা দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিক প্রতিনিধি চাই। শ্রমিক সংগঠন থাকলে এ ধরনের কর্মকাণ্ড কমে আসবে।’
গত সাড়ে তিন দশকে বাংলাদেশের পোশাক খাত ফুলেফেঁপে হষ্টপুষ্ট হয়েছে। এ খাতের কল্যাণে নতুন ধরনের উদ্যোক্তা, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ভোক্তাশ্রেণী গড়ে উঠেছে। এই খাতকে কেন্দ্র করেই অর্থনীতি বড় হয়েছে। সরকারি সমর্থন আর সস্তা শ্রমের কল্যাণে বিশ্বের অন্যান্য প্রতিযোগী দেশকে পেছনে ফেলে দ্রুত সামনে এগিয়েছে বাংলাদেশ। এই পথ চলায় অনেক প্রতিবন্ধকতা ছিল, উদ্যোক্তারা তা অতিক্রমও করেছেন সাফল্যের সঙ্গে।
২০০৮ সালের তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ ছাড়া সত্যিকার অর্থে তেমন কোনো অনতিক্রম্য চ্যালেঞ্জ পোশাক খাতকে মোকাবিলা করতে হয়েছে কমই। তাজরীন ফ্যাশনের পর রানা প্লাজা ধস খাতটির জন্য সত্যিকারের আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ বয়ে এনেছে। খাত-সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, ঈদের পর থেকে পোশাক খাতকে একই সঙ্গে বহুমুখী চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যে কারণে আগামী দিনগুলোকে কঠিন সময় বলে মনে করছেন পোশাকশিল্পের মালিকেরা।
এ প্রসঙ্গে এসরোটেক্স গ্র“পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মাদ আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘যেকোনো সময়ের তুলনায় আগামীর চ্যালেঞ্জ অনেক অনেক গুণ বেশি। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় রাষ্ট্রীয় সমর্থন, মালিক-শ্রমিকের সচেতনতা, বিনিয়োগ বাড়ানোসহ বহু কাজ করতে হবে। এর মাধ্যমেই বাংলাদেশের পোশাক খাত বিশ্বমানের হয়ে উঠবে। এতে আপাতত কিছুটা কষ্ট হলেও চ্যালেঞ্জে জিতলে সবচেয়ে বেশি লাভবান হবেন কারখানামালিকেরাই। ফলে সংকট দেখে বসে থাকার সময় এখন নয়, বরং বেশি কাজ করার সময়।’
সার্বিকভাবে বাংলাদেশের শিল্প খাত সংকটের মধ্যে আছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে কোনো শিল্পই তার সেরা পারফরমেন্স দেখাতে পারছে না। গ্যাস, বিদ্যুৎ, সড়ক, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি–এসব জায়গায় পোশাক কারখানামালিকদের কোনো হাত নেই। অবকাঠামোগত দুর্বলতা আগেও ছিল, এখনো আছে। দিনকে দিন চাহিদার তুলনায় দুর্বলতাগুলো তীব্রতর হচ্ছে। বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কারখানাগুলো চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাচ্ছে না। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব ঢাকা-লন্ডনের চেয়ে বেশি। দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মহাসড়ক যেমন বেহাল, তেমনি এর নিরাপত্তাব্যবস্থাও খুব দুর্বল। হাইওয়ে থেকে পোশাকশিল্প-সংশ্লিষ্ট কাভার্ড ভ্যান ছিনতাই, রপ্তানি পণ্যে আগুন দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে।
আসাদুল ইসলাম বলেন, ‘এই জায়গায় রাষ্ট্রের সমর্থন দরকার। গ্যাস-বিদ্যুৎ, রাস্তাঘাটের উন্নয়নের দায়িত্ব সরকারের। পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব আরও বেশি। যেনতেনভাবে ব্যবসা করার দিন শেষ। রানা প্লাজার ঘটনার পর বিদেশি ক্রেতারা নতুন নতুন অনেক কমপ্লায়েন্স যুক্ত করছে। ঈদের পরপরই শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাড়বে, পুরো ব্যবসায়িক সিস্টেমের উন্নয়ন ঘটাতে হবে, প্রোডাক্ট ডেভেলপমেন্ট করতে হবে, শ্রমিক-কর্মকর্তাদের ভালো ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। দক্ষ ব্যবস্থাপনা বা ম্যানেজমেন্ট গড়ে তুলতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ যারা উতরাতে পারবে, তারা টিকে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘ক্রেতাদের কমপ্লায়েন্স পূরণ করতে হলে নতুন করে প্রচুর বিনিয়োগ দরকার হবে। কারখানা পরিস্থিতির উন্নতি হলে, পোশাকের (পণ্য) উন্নয়ন ঘটানো গেলে এই বিনিয়োগ আবার মালিকদের কাছেই ফিরেই আসবে। তাই এখন যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে, তা মোকাবিলা করেই টিকতে হবে। আমি মনে করি, এটা একটা সুযোগ, সবার কাজে লাগানো উচিত।’
বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ন্যূনতম মজুরি কত হওয়া উচিত, তা নিয়ে শিল্পমালিক এবং শ্রমিকদের মধ্যেই ভিন্ন মত আছে। কিন্তু নতুন মজুরিকাঠামো ঘোষিত হলে তা খাতটিতে বাড়তি চাপ তৈরি করবে, তা স্বীকার করেছে উভয় পক্ষই। বেশ ক’জন প্রভাবশালী গার্মেন্টস-মালিক জানিয়েছেন, ন্যূনতম মজুরি হওয়া উচিত সাড়ে চার থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। আর শ্রমিক সংগঠনের বেশ কয়েকজন নেতা জানিয়েছেন, এই মজুরি হওয়া উচিত কমপক্ষে ৮ হাজার টাকা। তাহলে একজন শ্রমিক কোনোভাবে টিকে থাকতে পারবে।
মজুরি বাড়ানো নিয়ে কারও ভিন্নমত না থাকলেও এ জন্য প্রতি মাসে পোশাক খাতে বাড়তি কয়েকশো কোটি টাকার প্রয়োজন হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা মূল্য না বাড়ালে বিপুল পরিমাণ এই অর্থের সংস্থান কীভাবে হবে, তা একটি বড় প্রশ্ন। তবে ঠিকমতো ব্যবসা করতে পারলে মালিকেরা অর্থের সংস্থান করতে পারবেন। যাকে খুব বড় কোনো সমস্যা মনে করেন না পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা।
ঈদ-পরবর্তী রাজনৈতিক ঝড় সামলানো হবে পুরো অর্থনীতির জন্যই বড় চ্যালেঞ্জ। হাইকোর্ট জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ঘোষণা করায় ইতিমধ্যেই দলটি ১২ ও ১৩ তারিখ লাগাতার ৪৮ ঘণ্টা হরতালের ডাক দিয়েছে। নির্বাচন-পদ্ধতি কী হবে, এই প্রশ্নের মীমাংসা না হওয়ায় সব মহলেই উদ্বেগ আছে। ফলে ঈদের পর কঠোর হরতাল-অবরোধসহ কঠোর রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। রাজনৈতিক সমঝোতা না হলে পোশাক খাতের জন্য পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে দাঁড়াবে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাজনৈতিক সহিংসতা এবং অস্থিরতার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। হরতাল-অবরোধ রাজনৈতিক দলগুলোর গণতান্ত্রিক অধিকার। তা পালনেও কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু এসব কর্মসূচি যখন জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়, তখন তা কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক থাকে না। রাজনৈতিক সহিংসতার কারণেই আশির দশকে গার্মেন্টস-শিল্প শ্রীলঙ্কা থেকে বাংলাদেশে এসেছিল। অতীতে পোশাকশিল্প সব সময় রাজনৈতিক কর্মসূচির আওতামুক্ত থাকত।
বছর খানেক ধরে চলা রাজনৈতিক সহিংসতার শিকার হয়েছে পোশাক খাত ও এর পশ্চাৎসংযোগ শিল্পগুলো। রপ্তানিযোগ্য পণ্য পথে আটকে দেওয়া হয়েছে, পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে, ছিনতাই হয়েছে খাত-সংশ্লিষ্ট কাঁচামাল। এ অবস্থায় অসম্ভব ব্যয়বহুল হওয়া সত্ত্বেও কারখানামালিকেরা আকাশপথে বিদেশে পণ্য পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। শুধু আকাশপথে পণ্য পাঠাতে গিয়ে এবং রাজনৈতিক সহিংসতার কারণে ব্যাংক খেলাপিতে পরিণত হয়েছেন অনেক গার্মেন্টস-মালিক। এর মধ্যে বাংলাদেশের পোশাক খাতকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যেতে নর্থ আমেরিকান অ্যালায়েন্স, ইউরোপিয়ান একোর্ড নিয়ে আসছে ক্রেতারা। অর্থাৎ আমেরিকা ও ইউরোপীয় ক্রেতাদের জন্য আলাদা কমপ্লায়েন্সের শর্ত পূরণ করতে হবে কারখানামালিকদের।
সব মিলিয়ে সামনের দিনগুলো নিয়ে উদ্বিগ্ন পোশাকমালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। সংগঠনটির সভাপতি আতিকুল ইসলাম ‘সময় বিচিত্রা’কে বলেন, ‘আগামী কয়েক মাস পোশাক খাতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ আমাদের একসঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো রাজনৈতিক। ঈদের পর রাজনৈতিক দলগুলো কেমন কর্মসূচি দেয় ও আচরণ করে তার ওপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে পুরো দেশের মতো ক্রেতারাও তাকিয়ে থাকবে। আমরা আশা করি, সরকার-বিরোধী দল সবাই এ খাতের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারবে। সে অনুযায়ী তারা কর্মসূচি দেবে। রাজনীতিবিদেরা সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হলে কারখানামালিকেরা বাকি চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারবে।’
প্রায় এক দশক ধরে দেশের পোশাক খাত একটি দুষ্টচক্রের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। ফলে হাজার হাজার উদ্যোক্তা, লাখ লাখ শ্রমিক, পোশাক খাতের সুবিধাভোগী অন্য আরও অনেক খাত-উপখাত এই চক্রে প্রতিনিয়ত পিষ্ট হচ্ছে। এই বৃত্ত ভাঙতে না পারায় স্বস্তির জায়গা নিয়েছে উদ্বেগ ও ভয়। পোশাক খাতে এটাই বর্তমানে সবচেয়ে বড় সংকট। এর পেছনে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র, নীতি অস্থিরতা, অতিমাত্রায় মুনাফার মানসিকতা, শিক্ষিত ও সৎ উদ্যোক্তার অভাব, অপেশাদারি ব্যবস্থাপনা, অদক্ষ শ্রমিক, শ্রমবান্ধব ট্রেড ইউনিয়ন না থাকা, দক্ষ শ্রমিকের অভাব, কান্ট্রি ব্র্যান্ডিংয়ের অভাব, অর্থনীতি-বান্ধব কূটনৈতিক কৌশলের অনুপস্থিতি, কারণে-অকারণে শ্রমিক অসন্তোষ, রাজনৈতিক অস্থিরতার মতো নানা ঘটনার শিকার পোশাক খাত এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি।
তাজরীন বা সাভারের মতো দুর্ঘটনার জন্য যে মূল্য দিতে হয়, তা বহন করার সামর্থ্য পোশাক খাত তো বটেই বাংলাদেশেরই নেই। শিল্প থাকলে দুর্ঘটনাও ঘটবে। কিন্তু একে কত নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে, সেটাই হচ্ছে মৌলিক প্রশ্ন। বিদেশি ক্রেতা-কারখানামালিকেরা একটি জায়গায় একমত তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা রাজনৈতিক অস্থিরতা। বিদেশি ক্রেতারা যদি কোনো দিন মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে তা দুর্ঘটনার জন্য নয়, রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতার কারণেই নেবে। সাভারের ভবনধসের পর থেকে শ্রমিকের নিরাপত্তা ও কর্মপরিবেশে সবাই অতিমাত্রায় মনোযোগ দিলেও ব্যবসার খরচ কমাতে, বিদেশি ক্রেতার উদ্বেগ কমাতে স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের কোনো বিকল্প নেই। হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ, রাহাজানি, রাজপথে চাঁদাবাজি বন্ধ না হলেও অর্থনীতিতে ন্যায় প্রতিষ্ঠা কঠিন।
শিল্প যদি মানবিক হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, মালিক-শ্রমিকের সম্পর্ক যদি ভালো না হয়, ন্যায্যতার ভিত্তিতে শিল্পকে গড়ে তোলা না গেলে সেই শিল্প দীর্ঘ মেয়াদে টিকতে পারবে না।
বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, ‘আন্তর্জাতিক যেকোনো ব্যবসায় সব সময়ই কঠিন সময়। এ কথা ঠিক, যেকোনো সময়ের তুলনায় সামনের দিনগুলোয় চ্যালেঞ্জ অনেক বেশি। রানা প্লাজায় পোশাক খাতের ভাবমূর্তিতে যে ধস নেমেছে, তা পুনরুদ্ধার করতে হবে। এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতারা পোশাক কেনার ক্ষেত্রে যে চাহিদা বা শর্ত (কমপ্লায়েন্স) দিচ্ছে, তা পূরণ করার সক্ষমতা প্রমাণ করতে পারাটাই বেশি জরুরি। আমি মনে করি, পোশাকশিল্পের মালিকদের কাছে আন্তর্জাতিক চাহিদা পূরণের প্রশ্নটি সবচেয়ে বড়। অগ্নিনির্বাপক-ব্যবস্থার উন্নয়ন, শিল্পসহায়ক সুরক্ষিত ভবন, ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন তথা শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তাই ক্রেতা এবং মালিকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। পাশাপাশি উভয়ের মধ্যে খাত সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিও বড় চ্যালেঞ্জ।’
শ্রমিকদের ক্ষোভ প্রশমনে শুধু বেতন-ভাতা বাড়ানোই যথেষ্ট নয়। একজন শ্রমিক সবার আগে একজন মানুষ। তার মানবিক গুণাবলি আছে, আত্মসম্মানবোধ আছে এবং সামাজিক পরিচয় আছে। যখন প্রতিষ্ঠানে আত্মসম্মানবোধ বা অহমিকায় আঘাত করার মতো ঘটনা ঘটে, তখনো মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ফলে, বেতন-ভাতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানকে মানবিক করে তোলার উদ্যোগ থাকতে হবে। মধ্যম সারির ব্যবস্থাপনা নিয়ে বহু বছর ধরে বিতর্ক আছে। মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কারণে বহু কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের উদাহরণ আছে। আবার বেতন বাড়ার সুফল যেন শ্রমিকেরা ভোগ করতে পারে, সেই নিশ্চয়তাও দিতে হবে রাষ্ট্রকে।
বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন অকারণে বস্তির ঘর ভাড়া বেড়ে না যায়, নিত্যপণ্যের দাম যেন নাগালের মধ্যে থাকে, সেদিকে নজর দিতে হবে। শ্রমিকের কষ্টের অর্থ যেন বস্তির মাস্তানরা লুটে নিতে না পারে, সে লক্ষ্যে শক্ত উদ্যোগ থাকতে হবে। পোশাকশিল্প এত দিনে নিশ্চয়ই অনুধাবন করতে সক্ষম হয়েছে, লাখ লাখ শ্রমিককে অসন্তুষ্ট রেখে কোনোভাবেই এ খাতে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না। বরং সবাইকে বুঝতে হবে, শ্রমিকের রক্ত-ঘামেই উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগ নিরাপদ হয়েছে। বিলিয়ন ডলারের শিল্প হয়েছে পোশাক খাত।
দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে প্রতিযোগী দেশগুলো বাংলাদেশকে সার্বক্ষণিক কড়া নজরে রেখেছে। প্রতিযোগী দেশগুলোর ষড়যন্ত্র, মিথ্যে অপপ্রচারের ঘটনাও কম নয়। ভবিষ্যতে এসব ঘটনা আরও বাড়বে। ফলে, সামনের দিনগুলোয় নিয়মিত ভিত্তিতে বেতন সমন্বয় করার পাশাপাশি, শ্রমিকের জীবনের নিরাপত্তায় আরও বেশি বিনিয়োগ করতে হবে। সব কারখানাকে ঢাকার বাইরে নিয়ে যেতে হবে, সরকারি নজরদারি বাড়াতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন উন্মুক্ত করতে হবে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী দলকে একটি স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশের নিশ্চয়তা দিতে হবে। কিন্তু রাজনীতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নিয়ে পুরো অর্থনীতিরই উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে।
গার্মেন্টস শ্রমিক নেত্রী নাজমা আক্তার বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, শিল্পমালিকেরা তাদের সাধ্যমতো শ্রমিকদের বেতন বাড়াতে চেষ্টা করবেন। তবে এ ক্ষেত্রে বিদেশি ক্রেতাদের ভূমিকা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। এখন সময় এসেছে মূল্য বাড়ানোর। বিদেশি ক্রেতারা আমাদের রক্ত-ঘামে তৈরি কাপড় বিক্রি করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার মুনাফা করছে। এ হিসাব বিদেশি শ্রমিক ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান দিচ্ছে। এমনকি বিদেশি অনেক ক্রেতা স্বীকারও করছেন, বাংলাদেশে পোশাকের মূল্য বাড়ানো উচিত। তারা মূল্য বাড়ালে স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বেশি বেতন-ভাতা, সুযোগ-সুবিধা দিতে সক্ষম হবে।’
পোশাক খাতের জন্য আগামী দিন যেমন কঠিন, তেমন সম্ভাবনাময়ও বটে। রাজনীতির ওপর রাজনীতিবিদ ছাড়া কারোরই হাত নেই। তবে দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের সঙ্গে তাল মেলাতে হলে রাজনীতিবিদদেরও বুঝতে হবে, সহিংসতা কোনো সমাধান দেয় না, বরং ক্ষতই বাড়িয়ে তোলে। অতীতের মতো রাজনীতিবিদেরা এই খাতকে তাদের কোলাহল থেকে দূরে রাখবেন, এটাই দেশবাসীর কামনা। যে চ্যালেঞ্জ সামনে এসেছে তা মোকাবিলার সক্ষমতা বাংলাদেশের পোশাক খাতের আছে। দক্ষতার সঙ্গে এসব চ্যালেঞ্জ বা চাহিদা মেটাতে পারলে পোশাক খাত বিশ্বমানের হয়ে উঠবে। আর বাংলাদেশ সব দিক দিয়ে বিশ্বমানের হয়ে উঠুক, এটাই সবার কাম্য।
শেয়ার করুনঃ