বাংলাদেশের রাজনীতিতে ব্যক্তি-বন্দনার বিষয়টা আবারও সামনে এসেছে প্রধানমন্ত্রীর ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়ের একটি বক্তব্যকে ঘিরে। এরপর যোগ হয়েছে জয়ের জন্মদিনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মোরগ-পোলাও রান্নার খবর। তারপর মাকে নিয়ে পিতৃভূমি রংপুরে গিয়ে জনসভায় ভাষণ দেওয়া। সবশেষ জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিলের বিষয়ে তার ফেসবুকের স্ট্যাটাস। এই সব নিয়েই এখন চলছে জয়-বন্দনা, দলে এবং দলের বাইরে। যুবলীগের ইফতার পার্টিতে জয় বলেছেন, তার কাছে তথ্য আছে, সংখ্যা আছে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে। তার এই বক্তব্যকে ‘ষড়যন্ত্র’ বলেছে বিএনপি। সবকিছুতেই ষড়যন্ত্র খোঁজা রাজনীতিবিদদের পুরোনো অভ্যাস। তবে এখানে ষড়যন্ত্র খোঁজার একটু সুযোগ আছে। সেই সুযোগটা করে দিয়েছেন জয় নিজেই তার ভাষার মাধ্যমে। তিনি যখন বলেন তার কাছে তথ্য আছে আওয়ামী লীগ আবারও ক্ষমতায় আসবে, তখন তার অর্থ দাঁড়ায় এই যে, একটা তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টা তিনি নিশ্চিত করছেন। সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, কী সেই তথ্য? নির্বাচনের আগেই তিনি কীভাবে এটা নিশ্চিত করলেন? তাহলে কি তিনি এমন কোনো ঘটনার তথ্য জানেন, যার মাধ্যমে এটা নিশ্চিত করা যায়, আওয়ামী লীগই আবার ক্ষমতায় আসবে? সে ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হওয়াটা মোটেও অমূলক নয়। সেই সুযোগটাই নিয়েছে বিরোধী দল। তথ্য আছে বলতে জয় কী বোঝাতে চেয়েছেন, তার ব্যাখ্যা দিতে হয়েছে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে। একই কাজ করতে হয়েছে দলের দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, দলের মুখপাত্র মাহবুব উল আলম হানিফ এবং যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীকে। এ ছাড়া জয় নিজেও ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এত সব ব্যাখ্যার পর জানা গেল, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি জরিপের ফলাফল নিয়ে কথা বলেছেন জয়। সেই জরিপ বলছে, আসন জেতার হিসাবে আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে একটু এগিয়ে আছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই জরিপ ডিজিএফআই বা এনএসআইয়ের নয়, তাদের নিজস্ব। আরেকটু খোলাসা করেছেন জয়। জরিপটি বিদেশি একটা সংস্থা করেছে। এই তথ্য প্রকাশে দুজনের উদ্দেশ্যই পরিষ্কার। জরিপটা কত সঠিক বা গ্রহণযোগ্য, সেটা বোঝানোর চেষ্টা। এ ছাড়া সরকারি গোয়েন্দা প্রতিবেদন যে সঠিক হয় না, সেটাও স্বীকার করেছেন প্রধানমন্ত্রী। জয় যেহেতু জরিপে পাওয়া তথ্যের কথা বলেছেন, তাই তিনি তার বক্তব্যের পক্ষে সংখ্যা (আসলে হবে পরিসংখ্যান) থাকার কথাও বলেছেন। অর্থাৎ তিনি যা বলতে চেয়েছেন কিন্তু প্রথমবার পারেননি তা হলো, তার কাছে একটা জরিপের তথ্য ও পরিসংখ্যান আছে, যার ভিত্তিতে তিনি আশা করছেন আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতবে। বাংলা ভাষা বা রাজনীতির ভাষার ওপর যথেষ্ট দখল না থাকায় এমনটা হয়েছে। জয় হয়তো বুঝতে পারেননি, ভবিষ্যতে ঘটবে এমন কোনো ঘটনার কথা নিশ্চয়তা দিয়ে বলা যায় না। বলতে হয়, এটা হতে পারে, হওয়ার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা আছে, অথবা আশা করছি, এটা হবে বা সেটা হবে না ইত্যাদি। এ ক্ষেত্রে জয়ের জন্য সঠিক ও নিরাপদ বক্তব্যটা হতে পারত এমন: আশা করছি, আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতবে। কারণ, আমরা জরিপ চালিয়ে দেখেছি, আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে কিছুটা এগিয়ে আছে। অথবা হতে পারত এমনও: আমরা জরিপ চালিয়ে দেখেছি আগামী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জিতবে। যদিও জিতবে না বলে জিতার সম্ভাবনা আছে বলাটাই বেশি শ্রেয়। কিন্তু আমাদের রাজনীতিতে এত পরিশীলিত ভাষা ব্যবহার হয় না। আমরা জিতবই, ওরা হারবেই এমন নিশ্চয়তামূলক কথাই বেশি শুনে থাকি আমরা। কোনো অভিযোগ বা দাবির বেলায় তো আমাদের রাজনীতিবিদেরা ‘সুপারলেটিভ ডিগ্রি’ ছাড়া কথাই বলতে পারেন না। নিজের ভালোটাকে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ’ এবং অন্যের খারাপটাকে ‘ইতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট’ বলে থাকেন তারা। সঠিক শব্দ ব্যবহার না করে বক্তব্য দিলে কত রকম ঝামেলা বা বিপদ হতে পারে, তা এরই মধ্যে টের পেয়ে গেছেন বাংলাদেশের রাজনীতির নতুন এই রাজা। রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার অভ্যাস তার খুব বেশি দিনের নয়। উচ্চারণ স্পষ্ট ও বিশুদ্ধ হলেও শব্দচয়নে সমস্যা আছে। তা ছাড়া রাজনৈতিক বক্তব্যে যে ধরনের সতর্কতা ও কৌশল দরকার, তা হয়তো রপ্ত করতে পারনেনি এখনো। তবে কৌশলের নামে অসততা, হঠকারিতা, ধোঁকাবাজি থেকে দূরে থাকলে নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক হিসেবে তিনি নিশ্চয় অনেক সমাদৃত হবেন। রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার বেলায় জয়ের চেয়ে তারেক অনেক বেশি সতর্ক, অনেক বেশি কৌশলী। কারণ এই কাজটা তিনি অনেক বছর আগেই শুরু করেছেন। এক-এগারোর ধাক্কায় আরও দক্ষ হয়েছেন। জয়ের বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে আওয়ামী লীগের নেতারা বলেছেন, জয় এটা বা সেটা বোঝাতে চেয়েছেন। অর্থাৎ তিনি বোঝাতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি। তবে ৭১ টিভিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে জয় তার নিজের বক্তব্যের ব্যাখ্যা নিজেই দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যায় কোনো বিভ্রান্তি ছিল না, সেই কথার কোনো অপব্যাখ্যাও হয়নি। তার মানে রাজনীতিতে নতুন বলে তাকে একটা হোঁচট খেতে হয়েছে। এটা দোষের কিছু নয়। কিন্তু জয়ের বক্তব্য সমর্থন করতে দিতে আওয়ামী লীগ নেতারা যেভাবে তার বন্দনা করেছেন, সেটাই হলো সমস্যা। তারেক-জয়-বন্দনা কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে তা বোঝা গেল দুই দলের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নেতার মন্তব্য থেকে; মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের কথা না-ই বা বললাম। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেছেন, তারেক রহমান দেশে এলে আওয়ামী লীগ খড়কুটোর মতো ভেসে যাবে। আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক হাসান মাহমুদ বলেছেন, সজীব ওয়াজেদ জয় রাজনীতিতে আসছেন বলে বিএনপির মধ্যে অস্থিরতা শুরু হয়েছে এবং দলটির নেতারা আবোল-তাবোল বলছেন। তবে বন্দনা প্রতিযোগিতায় এখন পর্যন্ত এগিয়ে আছেন যুবলীগ চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরী। তিনি বলেছেন, জয়ের বক্তব্যটি ছিল বারাক ওবামার নির্বাচনী বক্তব্যের মতো উদ্দীপনামূলক। জয়ের বক্তব্য সারা বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে। যুগে যুগে রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের ধ্বংস করেছেন এই তৈলমর্দকেরা। নিজের স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের বন্দনা করেছেন চামচারা। আর এভাবেই দল, রাজনীতি ও দেশের বারোটা বাজিয়েছেন তারা। তারেক-জয়ের মতো নতুন প্রজন্মের আধুনিকমনা নেতাদের বন্দনা যেভাবে চলছে, তাতে একদিন তারাও এই অপরাজনীতিতে ডুবে যাবেন কি না সেই প্রশ্নই এখন বড় করে দেখা দিয়েছে।
নেতা-নেত্রীদের বন্দনা করা আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে খারাপ দিক। এই বন্দনাই ব্যক্তিকে দেশ ও দলের ওপরে জায়গা করে দিয়েছে, গণতান্ত্রিক সমাজেও রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। মুজিব-জিয়া- হাসিনা-খালেদার বন্দনা অনেক দিনের পুরোনো। জীবিত ও মৃত নেতা-নেত্রীদের বন্দনার কারণেই আমাদের রাজনীতিতে দেশ, জনগণ এমনকি দলীয় কর্মীদের গুরুত্বও হারিয়ে যায়। নেতা-নেত্রীদের তুষ্ট করতে না পারলে কর্মীদের রাজনৈতিক জীবনও ধূসর হয়ে যায়। একইভাবে শীর্ষ নেতৃত্বকে বন্দনা না করলে পরের কোনো নেতৃত্বই টিকে থাকে না। আর তাই সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েন নেতা-নেত্রীদের মন জোগাতে, মন রাঙাতে। কেবল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরাই নন, সামরিক-বেসামরিক আমলা, পেশাজীবী, বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী এমনকি বিচার অঙ্গনের মানুষও বাদ যান না। কেউ স্বেচ্ছায়, কেউ অনিচ্ছায়, বন্দনা তারা করেই যাচ্ছেন। নইলে পিছিয়ে পড়ছেন বা ক্ষতির মুখে পড়ছেন। ক’জনই বা ক্ষতিটা মানতে পারছেন?
বাংলাদেশের রাজনীতির দুই কীর্তিমান পুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমানের বন্দনা হয়তো চলতেই থাকবে। তাদের উত্তরসূরি শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার বন্দনা চলছে তিন দশক ধরে। এটাও নিশ্চয় চলবে আরও অনেক বছর। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে মুজিব-জিয়ার তৃতীয় প্রজন্মের রাজনৈতিক উত্তরাধিকার সজীব ওয়াজেদ জয় ও তারেক রহমানের বন্দনা। গণতন্ত্রের আবরণে এই রাজতন্ত্র বা পরিবারতন্ত্র সহজে শেষ হবে বলে মনে হয় না। কারণ, বড় দুটি দল ও তাদের নেতা-কর্মী-সমর্থকেরা তারেক-জয় বন্দনাও শুরু করে দিয়েছেন। তারেক-বন্দনা অবশ্য শুরু হয়েছে এক যুগ আগেই, যখন তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। এই এক যুগে তারেক-বন্দনা কখনো কখনো জিয়া-খালেদা-বন্দনাকেও ছাড়িয়ে গেছে। যদিও এক-এগারোর পর তাতে অনেক ভাটা পড়েছিল। ভাটা শেষে জোয়ারও এসে গেছে। কারণ, বন্দনাকারীরা বুঝে গেছেন, আগামীর রাজা তিনিই, বন্দনা তাকেই বেশি করে করতে হবে। তাতেই কপাল খুলবে। আর তাই তারেক বন্দনায় ঝাঁপিয়ে পড়ছেন দলের সবাই। দলের বাইরে থেকে যোগ দিচ্ছেন দালাল-চামচা-সুবিধাবাদীরাও। এর আগে কালেভদ্রে রাজনীতিতে আবির্ভাব ঘটত আরেক ভাবী রাজা জয়ের। এবার তিনি নিয়মিতই থাকবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। সে জন্য তার বন্দনাও শুরু হয়ে গেছে জোরেশোরে। আর নতুন বলে জয়-বন্দনা একটু বেশিই হচ্ছে। আমাদের নব্যরাজতন্ত্রের ইতিহাসটা কিন্তু মজার। প্রথমে দুই রাজা, তারপর দুই রানি, তারপর আবার দুই রাজা। এই ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে আবারও আসবেন দুই রানি। কারণ, তারেক-জয় দুজনকেই আল্লাহ কন্যা-সন্তান দিয়েছেন। বাপ-দাদিদের ইতিহাস জেনে জাইমা-সুফিয়ারাও নিশ্চয়ই সিংহাসনের স্বপ্ন দেখছে।
শেয়ার করুনঃ