২০০৭ সালে বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য বা ভাঙার জন্য অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তাদের কেউ দলের ভেতরে কোণঠাসা ছিলেন, কেউ কাক্সিক্ষত পদ না পেয়ে, আবার অনেকে গোয়েন্দা বাহিনীর চাপে পড়ে এমন কাজে জড়িত হয়েছিলেন। কেবল রাজনৈতিক দলের নেতারাই যে নিজেদের দল ভাঙার জন্য কাজ করেছেন, তা-ই নয়। দলের বাইরে থেকে গোয়েন্দা বাহিনীও একই কাজ করেছে সমান তালে। কিন্তু তার ফলাফল কী হয়েছিল? বলা যায়, তারা পুরোপুরি সফলও হননি, আবার ব্যর্থও হননি। তবে মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কেউই তেমন কিছু করতে পারেননি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে এটা বারবারই প্রমাণিত হয়েছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপিকে টুকরো করার জন্য নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হয়েছে। দলের মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়াসহ অনেক নেতাই চেষ্টা করেছেন, বিএনপি ভেঙে নতুনভাবে প্রায় একই নামে বিএনপি করা যায় কি না। মান্নান ভূঁইয়ার সাথে ছিলেন দলের একাধিক নেতা। তারা অনেক চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেননি। তবে দলের অনেক ক্ষতি যে তারা করতে পেরেছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এখনো তাদের কেউ কেউ বিএনপিকে আবারও টুকরো করার জন্য ওত পেতে আছে। কেবল সুযোগের অপেক্ষা। নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা আবারও সক্রিয় হচ্ছে।
বিএনপির মতো আওয়ামী লীগকেও ভাঙার চেষ্টা হয়েছে একই কায়দায়। কিন্তু এখানেও সফল হয়নি তারা। সব বাধা পেরিয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার কারণে যারা দল ভাঙার প্রক্রিয়ায় জড়িত ছিলেন, তারা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এখনো তারা কোণঠাসাই আছেন। ২০০৭ সালে সেনাবাহিনীর সমর্থন নিয়ে যারা দল গঠন করে আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে ভেঙে টুকরো করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, তাদের বেশির ভাগই এখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের অন্যতম একজন বিএনপির একসময়ের নেতা ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর পিডিপি নামে একটি দল গঠন করেন। এখন সেই দলের কোনো অস্তিত্বই নেই। বর্তমানে বিএনপিতে ফিরে আসার জন্য তিনি অনেক চেষ্টা করছেন বলে তার ঘনিষ্ঠজনেরা জানিয়েছেন।
তার মতো আরও কয়েকটি দল গঠন করা হয় তখন, যেগুলো কিংস পার্টি নামে পরিচিতি পায়।
মেজর জেনারেল ইব্রাহীমও একটি দল গঠন করেছিলেন তখন আওয়ামী লীগ-বিএনপিকে সাইজ করার জন্য। তিনি এখন আবার ছাতা ঘুরিয়ে ধরেছেন।
দলের বিরুদ্ধে গিয়ে কে কী পেয়েছেন?
বিএনপির প্রয়াত নেতা একসময় দলের প্রভাবশালী মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান ছিলেন ভীষণ জনপ্রিয়। কিন্তু সাবেক স্বৈরাচার এরশাদের সাথে আঁতাত করার চেষ্টার অভিযোগে তাকে দল থেকে বের করে দেওয়া হয়। তিনি বের হয়ে গিয়ে একটি দল গঠন করলেও বিএনপির ওপর বিন্দুমাত্র প্রভাব ফেলতে পারেননি। বরং তার বিশ্বাসঘাতকতার কারণে তখন বিএনপির জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গিয়েছিল।
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সংবিধান-প্রণেতা ড. কামাল হোসেন ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠজন। দেশ-বিদেশে তার অসংখ্য গুণগ্রাহী থাকলেও রাজনীতির মাঠে তিনি তার জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন আওয়ামী লীগ ছাড়ার পর। একাধিকবার নির্বাচনে দাঁড়ালেও কখনোই জিততে পারেননি খ্যাতিমান এই আইনজীবী । আজও তার দলের অবস্থা ওয়ান ম্যান শো। তিনিই নেতা তিনিই কর্মী।
বঙ্গবন্ধুর আরেক সহচর আবদুর রাজ্জাক। আওয়ামী লীগের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেছেন বিভিন্ন সময়ে। দল থেকে বের হয়ে গিয়ে তিনি দ্বিতীয়বারের মতো বাকশাল গঠন করেন। বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর যে বাকশাল আওয়ামী লীগ বিলুপ্ত ঘোষণা করেছিল, আবারও সেই বাকশাল গঠন করেছিলেন রাজ্জাক। কোনোভাবেই সেই বাকশাল এগিয়ে না নিতে পেরে তিনি আবারও ফিরে আসেন আওয়ামী লীগে। ২০০৭ সালে দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে বিরাগভাজন হন দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার। কোণঠাসা ছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। রাজ্জাকের সাথে যাওয়া আরেক বাকশাল নেতা মহিউদ্দীন আহমদের অবস্থাও শেষ দিন পর্যন্ত সুখকর ছিল না।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর শেখ হাসিনা দেশে ফেরার আগে আওয়ামী লীগের আরেক নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীও আলাদা আওয়ামী লীগ গঠন করেছিলেন। সেই দলের অবস্থাও ছিল শোচনীয়। পরে তিনি এরশাদের জাতীয় পার্টিতেও যোগ দিয়েছিলেন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হিসেবে। পরে তিনি আবারও আওয়ামী লীগে ফিরে এসেছিলেন।
আওয়ামী লীগের আরেক নেতা আবদুল মালেক উকিলও দল ভেঙে নতুন দল গঠন করেছিলেন। তিনিও সুবিধা করতে পারেননি নতুন দল গঠন করে।
বিএনপির একসময়ের প্রভাবশালী নেতা কর্নেল অলি আহমদ বিএনপি থেকে সরে গিয়ে এলডিপি নামে নতুন দল গঠন করেছিলেন। সেই দলের অবস্থাও একই রকম। এখন আবারও তিনি খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই রাজনীতি করছেন।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ের অন্যতম নেতা সাবেক রাষ্ট্রপতি ড. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বিএনপি থেকে বের হয়ে বিকল্পধারা নামের রাজনৈতিক একটি দল গঠন করেন। বিগত জাতীয় নির্বাচনে ভরাডুবি হয় দলটির। বিএনপির একসময়ের অত্যন্ত জনপ্রিয় এই নেতা ফেল করেন নিজ জেলা মুন্সিগঞ্জের আসনটিতেও। গত নির্বাচনে একটি আসনেও জিততে পারেনি বি চৌধুরীর গড়া বিকল্পধারার প্রার্থীরা। বি চৌধুরী ও তার দল বর্তমানে বিএনপির পাশে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন করছে। শোনা যাচ্ছে, দল বিলুপ্ত করে আবারও বিএনপিতে ফিরে যাবেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি।
জাতীয় পার্টির নেতা আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এরশাদের (জাতীয় পার্টি) কাছ থেকে সরে এসে নতুন দল গঠন করেন ‘জাতীয় পার্টি (জেপি)’ নামে। কিন্তু এই দলও কোনো রকমে টিকে আছে।
এরশাদের দলের আরেক নেতা নাজিউর রহমান মঞ্জুরও সরে এসে নতুন দল গঠন করেছিলেন। দলের নাম দেন বিজেপি। মানে বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি। এর ফলে এরশাদের জাতীয় পার্টি তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু এত কিছুর পরও এরশাদের জাতীয় পার্টির তেমন কোনো ক্ষতি হয়নি। মঞ্জুর মারা যাবার পর তার ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থ কোনো রকমে দলের হাল ধরে আছেন।
আওয়ামী লীগের একসময়ের নেতা বঙ্গবীর খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কাদের সিদ্দিকী আওয়ামী লীগ ছেড়ে ‘কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ’ নামে নতুন দল গঠন করেছিলেন অনেক দিন আগে। কাদের সিদ্দিকীর দলের অস্তিত্ব কেবল এখন তার মুখেই টিকে আছে।
ডাকসুর একসময়ের ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না সম্প্রতি ‘নাগরিক ঐক্য’ নামে একটি দল গঠন করেছেন। যদিও মান্না আওয়ামী লীগ থেকেও পদত্যাগ করেননি, আওয়ামী লীগও তাকে বহিষ্কার করেনি এখনো। ইতিমধ্যেই তিনি বেশ কয়েকটি আসনে কে কে নির্বাচন করবেন তার ঘোষণা দিয়ে দিয়েছেন। এটা আসলে রাজনৈতিক দল নাকি সামাজিক সংগঠন, সেটাও এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু তার পরও মাহমুদুর রহমান মান্নাই এই দলের কর্তা।
বিভিন্ন দলের একসময়ের ডাকসাইটে এসব নেতার অনেকেই ক্ষমতার লোভে, স্বেচ্ছায়, কারও প্ররোচনায় বা স্বার্থহানির প্রতিবাদে দলত্যাগ করলেও তারা এক প্রকার ফাঁদেই ধরা দিয়েছেন। ব্যক্তিকে তুলে ধরতে, ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হতে, নিজের হাতে একটি দলের নেতৃত্ব আছে, সেই সুখানুভূতি পেতেই বেশির ভাগ নেতা দলত্যাগ করেছিলেন বলেই ধারণা করা হয়।
সর্বশেষ বিএনপির একসময়ের তুখোড় নেতা, সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা সেই একই ধরনের ফাঁদে ধরা দিয়েছেন। বারবার নাটক করে একবার তিনি দল থেকে পদত্যাগ করেন, আবার দলে ফিরে আসার জন্য অনুনয়-বিনয় করেন। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়া যদি শেখ হাসিনার কাছে আলোচনায় বসার প্রস্তাব না দেন, তাহলে তিনি বিএনপি থেকে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটা যে একধরনের ফাটকাবাজি ছিল, সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল। তিনি পদত্যাগ করে আবারও ফিরে আসতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটা দলের আর কেউ মেনে নেয়নি। কারণ, এর আগেও তিনি একইভাবে পদত্যাগ করলে তার অনুরোধে আবারও তাকে সাধারণ সদস্যপদ ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তার পরিকল্পনা ছিল, তাকে আবারও দলে ফিরিয়ে নিলে নির্বাচনের আগ মুহূর্তে আবারও পদত্যাগ করার। সেটা বুঝতে পেরেই হয়তো বিএনপি তাকে আর ফেরত নেয়নি। তবে এ দেশের রাজনীতিতে এটা পরিষ্কার যে মূল স্রোতের বাইরে গিয়ে কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিই নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখতে পারেনি।
শেয়ার করুনঃ