সারা দিনে বুঝি একটিও শিকার পায়নি মাছরাঙাটা। তাই চোখে তার শিকারের নেশা। টেউতোলা জলের দিকে তাকিয়ে আছে গভীর অভিনিবেশে। মাছ ভেসে উঠলেই ছোবল দিয়ে মুখে তুলে নেবে। ভরদুপুরে বনস্পতির ফাঁকে ফাঁকে ঘন নীল অন্ধকার। সোনারঙ গ্রামে মেঘ ডাকে গম্ভীর স্বরে। এবেলা-ওবেলা বৃষ্টি আর কদমের মিষ্টি ঘ্রাণ জানিয়ে দেয় বর্ষার আগমনের কথা। ওগো বর্ষা, তুমি আমার ছেলেবেলায় পুকুরধারের হিজলগাছকে বৃষ্টির চাদরে ঢেকে দিতে, ঝাপসা করে দিতে দূরের সবুজ গ্রাম।
ছায়াঢাকা, পাখিডাকা শান্ত এক গ্রাম সোনারঙ। কালে কালে অনেক কীর্তিমান মানুষ জন্মেছেন এই গ্রামে। পণ্ডিত ক্ষিতিমোহন সেন, প্রফুল্ল নাথ, সত্যেন সেন এবং ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বেশ কয়েকজন বিপ্লবীর জন্মও এখানে। মুন্সিগঞ্জের টঙ্গীবাড়ি উপজেলার এই গ্রামেই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ঐতিহ্যবাহী জোড়া মন্দির। পশ্চিম দিকের মন্দিরটি কালীমন্দির আর পুবেরটি শিবমন্দির। পশ্চিমের মন্দিরটি পুবেরটির চেয়ে উঁচু। অপরূপ কারুকার্যমণ্ডিত মন্দির দুটি ১৮৪৩ ও ১৮৪৬ সালে তৈরি করেন স্থানীয় ধনী রূপচন্দ্র। অতিথিপরায়ণ সোনারঙবাসী মনে করেন, পাখি আর পুরাকীর্তি আছে বলেই এখানে দূর-দূরান্ত থেকে প্রতিদিন অসংখ্য মানুষ আসে।
সোনারঙ গ্রামের এই মন্দির, বিশেষত টিয়া ও শালিকের অভয়াশ্রম। মন্দিরের সামনে বিশাল একটা দিঘি। এখানেই মাছের আশায় সারা দিন উড়ে ঘুরে বেড়ায় একজোড়া পাতি মাছরাঙা। এদের বাসা দিঘির পাড়েই। দিঘির জলে বাঁশঝাড় বেয়ে নেমে আসা ছায়া খেলা করে সারাক্ষণ। মেঘময় সূর্যটাও যেন আলো দিয়ে চুপিচুপি দূরে চলে যায়। কাজলদিঘিতে জোড়া মন্দিরের ছায়া ভাসে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটায় ছায়াগুলো মৃদু নড়েচড়ে ওঠে। একটি খেজুরগাছ সার্কাস-খেলোয়াড়ের মতো শরীর বাঁকিয়ে মাথা তুলে দিয়েছে ওপরের দিকে। খেজুরগাছে বসে বড়শিতে মাছ ধরছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। ঢোলকলমির ডালে এসে বসেছে একটা পাতি মাছরাঙা।
পাতি মাছরাঙার ইংরেজি নাম Common Kingfisher । বৈজ্ঞানিক নাম Alcedo atthis। এদের ছোট মাছরাঙা কিংবা খুদে মাছরাঙাও বলেন কেউ কেউ। শরীরের মাপ ১৫ থেকে ১৮ সেন্টিমিটার। ওজন ২৫ গ্রামের মতো। ঠোঁট ৪ সেন্টিমিটারের একটু বেশি। প্রাপ্তবয়স্ক পাখির পিঠ সবুজাভ নীল ও দেহতল কমলা। তার ওপরে হালকা বাদামি আভা। ঘাড়ে সরু সাদা রেখা। চোখের পাশে লালচে ছোপ। তাতে কমলার মিশ্রণ। লেজ নেই বললেই চলে। পুঁচকে লেজের উপরিভাগ নীল। শক্ত ঠোঁটে তীক্ষè ধার। ওপরের ঠোঁট কালো আর নিচেরটির রং লাল। চোখ পিঙ্গল বাদামি। চোখের বৃত্ত কমলা। পা ও পায়ের পাতা প্রবালরঙা। সব রংই উজ্জ্বল।
পাতি মাছরাঙা মাছশিকারি পাখি। ছোট ছোট মাছের পাশাপাশি খায় জলজ পোকামাকড়। খেতে পছন্দ করে ব্যাঙের ছানাও। সাধারণত একা বা জোড়া বেঁধে থাকে। পানির সামান্য ওপরে ভেসে থাকা ডাল অথবা খুঁটিতে বসে থাকে। হঠাৎ ঝাঁপ দিয়ে পানি থেকে ছোঁ মেরে শিকার ধরে। জলের গভীরেও চলে যায়। এরা দ্রুত গতিতে ওড়ে প্রায় জল ছুঁয়ে। মার্চ থেকে জুন মাসে প্রজনন-ঋতুতে জলাশয়ের ধারে খাড়া ঢিবিতে গর্ত খুঁড়ে বাসা বানিয়ে ডিম পাড়ে। ডিম দেয় ছয়টি। ডিমগুলো সাদা ও গোলাকার। ডিম ফোটে ১৯ থেকে ২১ দিনের মাথায়।
আট ধরনের মাছরাঙা আছে আমাদের দেশে। এদের মধ্যে সাদাবুক মাছরাঙা আর পাতি মাছরাঙাই চোখে পড়ে বেশি। এরা আমাদের প্রতিবেশী। লোকালয়ে থাকে বলে মানুষকে তেমন একটা ভয় পায় না। দেশের প্রতিটি গ্রামেই ওরা আছে। পুকুর-দিঘি, ডোবা-নালা, বিলঝিল, হাওর-বাঁওড়, উপকূলীয় অঞ্চলের পাশাপাশি সব ধরনের জলাভূমিতে বিচরণ করে। ডাকে সুরেলা কণ্ঠে। দৃষ্টিশক্তি প্রখর। মাঝেমধ্যে লেজ ঝাঁকুনি দিয়ে নাচে। মেঘময় দিনে তাদের শরীরের রং জ্বলজ্বল করে ওঠে।
বর্ষার দুই আহ্লাদী মাস আষাঢ় আর শ্রাবণ। এ সময়ে কখনো ওঠে রোদ, কখনো নামে বৃষ্টি। পাশের কোনো গ্রাম থেকে গায়ে এসে লাগে ভেজা বাতাস। কাছেপিটে কোথাও বাজ পড়েছে। সেই শব্দে দিঘির মাছ উঠে আসে ডাঙায়। তার শরীরেও বর্ষার নব উচ্ছ্বাস। শিকার পেয়ে মাছরাঙার বুকে আনন্দ যেন আর ধরে না। সোনারঙ গ্রামে এখন বৃষ্টি হচ্ছে। ঝুমঝুম বৃষ্টি।
শেয়ার করুনঃ