ঈদ আরবি শব্দ। এর অর্থ আনন্দ বা খুশি। ইংরেজিতে একে বলা হয় ঈদ ফেস্টিভ্যাল। ঈদের শুভাগমনে মুসলমানদের হৃদয়ে সৃষ্টি হয় আনন্দের অনুরণন, প্রবাহিত হয় খুশির ফোয়ারা। ঈদের খুশি আলোড়িত করে প্রতিটি মুসলিম প্রাণকে। মহানবী হজরত মুহম্মদ (সা.) মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করার পর এ উৎসবের প্রবর্তন করেন। দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধির সাধনায় উত্তীর্ণ হওয়ার আনন্দে এবং সংযম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে জাতি গঠনের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে পবিত্র রমজানের পর পয়লা শাওয়াল বিশ্ব মুসলিম এ উৎসব পালন করে থাকে। এ উৎসবে প্রত্যেক সংগতিপূর্ণ মুসলমান পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের জন্য নির্দিষ্ট হারে অর্থ গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন। একে বলে ফিতরা। আর এ কারণেই এ উৎসবের নামকরণ হয়েছে ঈদুল ফিতর।
ঈদুল ফিতরের দিনে ধনী-গরিব সবাই সকালবেলায় উত্তমরূপে গোসল করে নানা প্রকার মিষ্টিজাতীয় দ্রব্যাদি বা খেজুর খেয়ে এবং যে যতটুকু পারে সাধ্যমতো পরিষ্কার ও নতুন পোশাক পরিধান করে অ্যালকোহলমুক্ত সুগন্ধি গায়ে মেখে ঈদগাহে ঈদের নামাজ পড়তে যায়। নামাজ শেষে সবাই সব ধরনের বিরোধ ও শত্র“তা ভুলে একে অপরকে আলিঙ্গন করে। এই ঈদ উৎসব নিছক সামাজিক অনুষ্ঠান নয়। এর একটি ধর্মীয় চেতনা আছে।
এই দিবস ও রজনীর ইতিকর্তব্য সম্পর্কে নিচে কতিপয় হাদিস উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
শাওয়ালের চাঁদ ওঠামাত্র ঈদুল ফিতরের রজনী শুরু হয়ে যায়। বাইহাক্বি ইবনু আব্বাস কর্তৃক বর্ণনা করেছেন, ঈদুল ফিতরের রজনী ফেরেশতাগণের নিকট লাইলাতুল জায়িজাহ-পারিতৌষিক প্রদানের রাত্রি নামে পরিচিত। (আত তারগিব)
যারা উক্ত রাতে ইবাদত করবে তারা পরকালে বেহেশতে বাস করবে। (আত তারগিব, ২য় খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)
আল্লাহ তাআলা ঈদের রজনীতে রমজানের সমস্ত মাস অপেক্ষা অধিকসংখ্যক জাহান্নামি বান্দাদের মুক্ত করেন। (আত তারগিব, ২য় খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)
তাই এই রাতে আল্লাহর কাছে সকল মরহুম আত্মীয়স্বজনের জন্য ক্ষমা চাওয়া উচিত।
ইসবাহানি আবু হুরাইরা (রা.)-এর বাচনিক বর্ণনা করেছেন, ঈদুল ফিতরের পূর্ব রাত্রে ফেরেশতাগণের অন্তরে ওঠে আনন্দের উল্লাস। আল্লাহ তাআলা তাদের জিজ্ঞেস করেন, ‘হে ফেরেশতাগণ, দীন-মজুর তার কার্য সমাপ্ত করলে তার সাথে কী ব্যবহার করা উচিত?’ ফেরশতাগণ বলবেন, ‘পূর্ণ পারিশ্রমিক প্রদান করাই বাঞ্ছনীয়।’ অতঃপর ফেরেশতাগণকে সাক্ষ্য করে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আমি উম্মাতে মুহম্মদীয়ার রোজাদার ব্যক্তিদের পাপরাশি সম্পূর্ণরূপে ক্ষমা করে দিলাম। (আত তারগিব, ২য় খণ্ড, ২২১ পৃষ্ঠা)
ঈদের দিন সকালে ঈদের মাঠের চতুষ্পার্শ্বে ফেরেশতাগণ দলে দলে রাস্তার মাথায় দাঁড়িয়ে মাঠে আগন্তুক মুসল্লিগণকে অভ্যর্থনা জানান এবং রোজার পারিশ্রমিক গ্রহণ করতে আহ্বান জানান। ঈদের নামাজ শেষ হলে তারা বলেন, ‘মুসলিমগণ, আপনারা পাপশূন্য হয়েছেন, এখন উৎফুল্লচিত্তে পুণ্যের বোঝা বহন করে আপন গৃহে প্রত্যাবর্তন করুন।’ আল্লাহ তাআলা বলবেন, ‘হে ফেরেশতাগণ, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমি তাদের কার্যে সন্তুষ্ট হয়েছি এবং আমার সন্তুষ্টিও তাদের প্রদান করেছি।’ পুনরায় ধ্বনি হবে, ‘হে আমার দাসদাসীগণ, আমার কাছে চাও, আমার সম্মান, প্রতাপ ও মহিমান্বিত নামের শপথ করে বলছি, আজ তোমরা দুনিয়া ও আখিরাতের জন্য যা প্রত্যাশা করবে, প্রদান করব। আমার রহমতের পানি দ্বারা তোমাদের পাপরাশি বিধৌত করলাম; তোমরা পাপমুক্ত হয়ে স্ব স্ব গৃহে প্রত্যাবর্তন করো। (আত তারগিব, ২য় খণ্ড, ২২৩ পৃষ্ঠা)
ফিতরা বা জাকাতুল ফিতর
আমরা মানুষ। ত্র“টি-বিচ্যুতি মানুষের সহজাত। রোজা রাখার সময় আমাদের নানা ত্র“টি হয়ে থাকে। অতএব, সেই সমস্ত ত্র“টি-বিচ্যুতি থেকে রোজাদারকে পবিত্র করার জন্য এবং দীন-দুঃখীদের আহার জোগান মানসে অর্থাৎ মুসলিম সমাজের অর্থনৈতিক বৈষম্য বিদূরিত করণার্থে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তার রাসুলের মুখে জাকাতুল ফিতর বা ফিতরার আবশ্যকতা এবং ফরজিয়াত ঘোষণা করে দিয়েছেন।
বুখারি, মুসলিম, আবু দাউদ প্রভৃতি আব্দুল্লাহ ইবনু উমার ও আব্দুল্লাহ ইবনু আব্বাসের (রা.) প্রমুখাৎ রিওয়ায়াত করেছেন,
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিতরাকে ফরজ করেছেন। (বুখারি)
বুখারির অন্য বর্ণনাতে আছে, ফিতরা প্রদানের জন্য রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নির্দেশ দিয়েছেন।
ফিতরা পরিশোধ না করা পর্যন্ত রোজা আকাশ-পাতালের মধ্যে ঝুলানো থাকে। অর্থাৎ এটা আল্লাহর নিকট গৃহীত হয় না।
ঈদের দিন সুবহে সাদিকের সময় ‘হাওয়ায়েজে আসলিয়া’ অর্থাৎ জীবিকা নির্বাহের অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ (যথা পরিধানের বস্ত্র, আহারের খাদ্যদ্রব্য ইত্যাদি) ব্যতীত ৮৭.৪৫ গ্রাম (সাড়ে ৭ তোলা) সোনা বা ৬১২.১৫ গ্রাম (সাড়ে ৫২ তোলা) রুপা বা অনুরূপ পরিমাণ মূল্যের অন্য কোনো মালের মালিক হলে সদকাতুল ফিতর ওয়াজিব। ফিতরা ওয়াজিব হওয়ার জন্য তেজারতের মাল বা পূর্ণ এক বছর অতিক্রান্ত হওয়া শর্ত নয়।
নিজের ও নাবালেগ সন্তানদের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করতে হয়। মহিলাদের কেবল নিজের পক্ষ হতে ফিতরা দেওয়া ওয়াজিব। নাবালেগ সন্তানের নিজের মাল থাকলে তা থেকেই ফিতরা দিতে হবে। বালেগ সন্তানদের পক্ষ হতে ফিতরা আদায় করা মুস্তাহাব।
ঈদের নামাজের পূর্বেই ফিতরা আদায় করা ভালো।
জাকাত
রমজান মাসে দান-খয়রাতের সওয়াব অন্যান্য মাস হতে সত্তর গুণ বেশি। তাই এ মাসে জাকাত আদায় করার সওয়াবও অনেক বেশি। সঠিক পরিমাণে জাকাত আদায় করলে আল্লাহ তাআলা সম্পদ বৃদ্ধি করে দেন। জাকাত বিক্ষিপ্তভাবে বা অল্পস্বল্প করে সবাইকে না দিয়ে নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে এমনভাবে প্রদান করা, যেন সে ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী হতে পারে। জাকাত প্রদানের ক্ষেত্রে নিকটতম দরিদ্র আত্মীয়স্বজন অগ্রাধিকার পেতে পারে। ‘হাওয়ায়েজে আসলিয়া’ ব্যতীত যে ব্যক্তি ৮৭.৪৫ গ্রাম (সাড়ে ৭ তোলা) সোনা বা ৬১২.১৫ গ্রাম (সাড়ে ৫২ তোলা) রুপা কিংবা তৎপরিমাণ মূল্যের টাকার মালিক হয় এবং এ পরিমাণ মাল পূর্ণ এক বছরকাল স্থায়ী হলে ওই ব্যক্তির ওপর শতকরা আড়াই ভাগ জাকাত ফরজ হবে।
ঈদুল ফিতরের দিনে করণীয় কাজ ও সুন্নতসমূহ
১. অতি প্রত্যুষে বিছানা হতে ওঠা ও ফজরের নামাজ আদায় করা
২. মিসওয়াক করা।
৩. গোসল করা।
৪. শরিয়তের সীমাবদ্ধতা থেকে যথাসাধ্য সুসজ্জিত হওয়া।
৫. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে মিষ্টিজাতীয় কিছু খাওয়া।
৬. ঈদগাহে যাওয়ার পূর্বে জাকাত, ছদকা-ফিতরা আদায় করা।
৭. কোনো অসুবিধা না থাকলে ঈদগাহে নামাজ পড়া, ঈদগাহ ছেড়ে মহল্লার মসজিদে ঈদের জামাত করা সুন্নতের খেলাফ।
৮. ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া ভালো এবং ঈদগাহে যাওয়ার সময় ‘আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়ালিল্লাহিল হামদ’ দোয়া পাঠ করা।
৯. ঈদের নামাজ বেশি দেরি না করে সঠিক সময়ে পড়া এবং ঈদের জামাতে কাতার সোজা রাখা জরুরি।
১০. ঈদের খুৎবা শোনা ওয়াজিব। ওই সময় হট্টগোল করা, চাঁদা উঠানো ইত্যাদি ঠিক নয়।
১১. ঈদের দিন ঈদগাহ, মসজিদ বা বাড়িতে ঈদের নামাজের পূর্বে অন্য কোনো নফল নামাজ পড়া মাকরুহ। অবশ্য ঈদের নামাজ আদায় করার পর বাড়িতে বা মসজিদে নফল পড়া মাকরুহ নয়।
১২. যদি কেউ একাকী ঈদের নামাজ না পায় অথবা নামাজ পেয়েছিল কিন্তু কোনো কারণবশত নামাজ পড়তে না পারে, তবে একা একা ঈদের নামাজ কাজা করবে না এবং কাজা করা ওয়াজিবও নয়।
১৩. যদি কারণবশত সকলের নামাজ না পড়া হয়, তাহলে পরবর্তী সময়ে নামাজ পড়ে নেবে। এমন ব্যক্তিকে ইমাম বানাবে, যিনি ঈদের নামাজ আদায় করেননি।
১৪. যদি কারণবশত পয়লা শাওয়াল দ্বিপ্রহরের পূর্ব পর্যন্ত ঈদুল ফিতরের নামাজ না পড়া হয়, তাহলে ২ শাওয়াল তারিখেও পড়তে পারবে, এরপর জায়েজ হবে না।
১৫. যদি কেউ ইমামকে দাঁড়ানো অবস্থায় ক্বেরাত পায়, তাহলে নিয়ত বেঁধে একা একা অতিরিক্ত তাকবির বলে নেবে। আর যদি ইমামকে রুকুর ভেতর পায়, তাহলে যদি দৃঢ় বিশ্বাস হয়ে যে, তাকবির বলেও ইমামকে রুকুতে পাওয়া যাইবে, তাহলে তিন তাকবির বলে পরে রুকুতে শরিক হবে। অন্যথায় তাকবির ছেড়ে রুকুতে শরিক হবে। রুকুতে রুকুর তাসবিহ না পড়ে প্রথমে তাকবির বলবে, এরপর সময় থাকলে তাসবিহ পড়বে। রুকুতে তাকবির বলার সময় হাত উঠাবে না।
১৬. যদি কেউ দ্বিতীয় রাকাতে শামিল হয়, তাহলে ইমামের সালামের পর প্রথম রাকাত পড়ার জন্য দাঁড়াবে এবং সানা, তাআওউয, সুরা-ক্বেরাত পড়ে রুকুর পূর্বে তাকবির বলবে।
১৭. যদি ইমাম সাহেব দণ্ডায়মান অবস্থায় তাকবির ভুলে যান, অতঃপর রুকুর অবস্থায় স্মরণ হয়, তাহলে রুকু অবস্থায় তাকবির বলবেন।
ঈদ-পরবর্তী আমল
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি রমজানের রোজা পালন করার পর শাওয়াল মাসের আরও ছয়টি রোজা পালন করবে, আল্লাহ তাআলা তাকে পূর্ণ বৎসরের রোজার পরিমাণ সওয়াব প্রদান করবেন। (তিরমিজি, মুসলিম, আবু দাউদ)
রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের এ মাসের সকল নেয়ামত আল্লাহ আমাদের মাঝে দান করুন। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা। ঈদ মোবারক।
শেয়ার করুনঃ