অনেক রাত। দেয়ালে ঝুলে থাকা ঘড়িটা থেকে টিকটিক শব্দ আসছে। ঘুরছে সেকেন্ড-মিনিট-ঘণ্টা। ঘর অন্ধকার বলে সময় দেখার সুযোগ নেই। ইচ্ছেও করছে না উঠে বাতি জ্বালিয়ে সময় দেখার। বারান্দার দরজা দিয়ে হু হু করে বাতাস ঢুকছে। পতপত শব্দে পর্দা উড়ছে। ফাগুনের এই মাতাল হাওয়ায় খানিকটা শীত শীত করছে সেকান্দার সাহেবের। আকাশে অর্ধচন্দ্র। আলো-ছায়ার আঁধারিতে ষোলোতলার এই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে ভুতুড়ে নগরীর বেশ খানিকটাই দেখা যাচ্ছে। বেশির ভাগ বাড়ির লাইট নেভানো। ডিম লাইটের মিটিমিটি আলো ছাপিয়ে উঠছে স্ট্রিট লাইটগুলো। কেমন যেন এক রহস্যময়তা আর নির্জনতা চারপাশে।
পাশের ঘরে ছোট্ট বিছানায় মাকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে ইহান। নিষ্পাপ সৌম্য চেহারা যেন জ্বলজ্বল করছে হলুদ মিটিমিটি ডিম লাইটের আলোয়। পর্দা সরিয়ে এক পলক দেখে আবার জানালার গ্রিলে হাত রাখলেন সেকান্দার সাহেব। বুকের ঠিক বাম দিকটায় চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। সেই রাত ১২টা থেকে একটি চিঠি লেখার চেষ্টা করছেন। পারছেন না। কিছুই মাথায় আসছে না, কী লিখবেন। যত ভাবছেন, কিছু লিখতে পারছেন না…ততই জেদ বাড়ছে। রাগ লাগছে। মনখারাপের পরিমাণটা বাড়ছে। ডুকরে কেঁদে উঠতে ইচ্ছে করছে।
জানালা লাগোয়া টেবিলে রাইটিং প্যাড। কলম। আবছা অন্ধকারে টেবিলে এসে বসলেন সেকান্দার সাহেব। গোটা দশেক কাগজ দুমড়ানো-মোচড়ানো টেবিলে। কিছুতেই যে লেখা হচ্ছে না। সেই সন্ধ্যায় ঠিক করেছেন, অন্ধকারে চিঠি লিখবেন। কিন্তু এখন যে আর মাথায় কিছু আসছে না। রাইটিং প্যাডে আলো-আঁধারিতে অনবরত লিখে চলেছেন প্রিয় উমামা, আমার উমামা, উমামা…সম্ভাষণই তো ঠিক করা যাচ্ছে না। একেক পাতায় একেক সম্ভাষণ লিখছেন আর মনের মতো হচ্ছে না বলে দুমড়েমুচড়ে ছুড়ে ফেলছেন টেবিলে।
দমকা হাওয়ার তোড়ে ঘরময় ছড়িয়ে গেল দোমড়ানো কাগজগুলো। টেবিলে মাথা গুঁজে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করলেন সেকান্দার সাহেব। কীভাবে লিখবেন চিঠিটি। আজ রাতেই যে পৌঁছাতে হবে উমামার কাছে।
হঠাৎ শীতল একটি হাতের স্পর্শে গায়ে কাঁটা দিল। পেছন ফিরে তাকাতেই বাকরুদ্ধ হলেন সেকান্দার সাহেব। পেছনে যে ছোট্ট একটি পরি। ফুটফুটে পরি। আলোয় ভরে গেছে চারপাশ। বিস্ফারিত চোখে বিস্ময়ে হতবাক হলেন সেকান্দার সাহেব। এ-ও কি সম্ভব?
ছি বুড়ো খোকা, কাঁদছ কেন? বড়রা কখনো কাঁদে?
আমি যে কিছু লিখতে পারছি না। আমার মাথায় কিছু আসছে না কী লিখব? বিস্ময় কাটিয়ে সহজ উত্তর সেকান্দার সাহেবের।
ছোট্ট পরি এগিয়ে এল। লাফিয়ে কোলে উঠে জড়িয়ে রাখল সেকান্দার সাহেবকে। গোটা গোটা হাতের আঙুলে চোখের কোনায় জমে থাকা অশ্রুবিন্দু মুছে দিল। পরিকে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন সেকান্দার সাহেব।
অদ্ভুত এক ভালো লাগায় ভরে গেল মন। কষ্টের স্রোত বেয়ে যখন এক মুঠো ভালো লাগা আসে, তখন সেটিই মানুষের কাছে মূল্যবান হয়ে ওঠে, বহু মূল্যবান। মানুষের জীবনে কত ঘটনাই না ঘটে, যার কোনোটির ব্যাখ্যা থাকে আর কোনোটি হয়তো ব্যাখ্যাতীত হয়েই থেকে যায়, যার খবর কেউ জানে না বা জানা সম্ভবও হয় না। আজ যেমন বিকেল থেকে বুকের ভেতর জমাট বাঁধা সব কষ্টরা যেন ঝরনাধারা হয়ে গড়িয়ে যেতে থাকে সেকান্দার সাহেবের চিবুক বেয়ে। ফুটফুটে পরি শক্ত করে জড়িয়ে রাখে সেকান্দার সাহেবকে। পরিরও যে মন খারাপ।
পরি কোল থেকে নেমে সারা ঘর হেঁটে বেড়ায়। দুমড়ানো-মোচড়ানো কাগজ বুকে তুলে নেয়। এই তো চিঠি…এই তো লিখেছ তুমি…
কাগজের টুকরোগুলো এগিয়ে নিয়ে যায় সেকান্দার সাহেবের কাছে। একেকটা খুলতে থাকে। খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। হাসির এই রিনিঝিনি যেন কত দিন, কত মাস, কত বছর পর নূপুরের শব্দ হয়ে কানে বাজে সেকান্দার সাহেবের। যেন যুগজনমের চেনা এই হাসি। বড় আপন, বড় মধুর এই হাসি। স্মৃতির অতলে তলিয়ে যেতে থাকেন সেকান্দার সাহেব। জাগরণ, তন্দ্রা, বাস্তব আর পরাবাস্তবের এক বিশাল জগৎ যেন ধীরে ধীরে গ্রাস করে তাকে। ষোলোতলার এই অ্যাপার্টমেন্টের মেঝে ফুঁড়ে যেন নিচে নামতে থাকেন তিনি। উল্টো ঘুরতে থাকে ঘড়ির কাঁটা। থিতু হতে থাকে ধীরে ধীরে। এক বছর আগের এই দিনে এসে থেমে যায়। নিস্তব্ধ হয়ে যায় চারপাশ। যেদিন আঁধার গ্রাস করেছিল এই পৃথিবীটাকে। সবকিছু যেন উল্টো দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে সেকান্দার সাহেবকে।
টানা বেজে চলেছে টেলিফোন সেটটা। দুপুরে খাওয়ার সময়ও পাননি। অফিসের জরুরি মিটিং বলে মোবাইল ফোন সাইলেন্ট সেই সকাল থেকে। সাড়ে ৫ কোটি টাকার একটা অর্ডার সামান্য ভুলে বাতিল হতে বসেছে। মন-মেজাজ এমনিই খিঁচড়ে আছে। তার ওপর একনাগাড়ে বেজে চলা ফোনে ভেতরে ভেতরে ফুঁসে উঠলেন সেকান্দার সাহেব। অনেকটা বিরক্তি নিয়েই ফোন তুললেন তিনি।
হ্যালো।
ওপাশে কান্নার শব্দ। ফুঁপিয়ে কাঁদছেন সেকান্দার সাহেবের স্ত্রী শ্যামলী নাসরীন।
হ্যালো, কী হয়েছে, বলো।
ওপাশে কান্নার শব্দ।
আচ্ছা বাবা, বলতে তো হবে কী হয়েছে। আমি বুঝব কীভাবে তুমি কোথায়?
অনেক কষ্টে দুটি শব্দ বুঝতে পারলেন সেকান্দার সাহেব। উমামা। লাইফটাইম হসপিটাল।
কখন চেয়ার ছেড়েছেন, অফিস থেকে কীভাবে ছুটে গাড়ির কাছে এসেছেন মনে নেই। সময় ওলটালেও কিছু খণ্ডিত অংশের কোনো রেকর্ড থাকে না হয়তো। এই সময়টারও কোনো রেকর্ড মুছে গেছে হয়তো। ড্রাইভার মনিরকে চালাতে বললেন লাইফটাইম হসপিটাল। মতিঝিলের ব্যস্ততম এই সড়কে এখন অফিসফেরত মানুষের জটলা। টাইট করে আঁটা জানালা ভেদ করে সেকান্দার সাহেবের মাথায় ভোঁ ভোঁ করছে। ভেঁপু সাইরেনের শব্দ গ্রাস করছে। দুহাতে কান চেপে রাখছেন। এসির ঠান্ডা বাতাসেও দরদর করে ঘামছেন। বিশ্রী রকমের যানজটে আটকে আছে সব পথঘাট। মতিঝিল থেকে বারিধারার লাইফটাইম হাসপাতাল যেন যোজন যোজন দূর। দুহাতে দুই ফোনে সমানে ডায়াল করতে থাকেন সেকান্দার সাহেব। কললিস্ট থেকে বউ, আম্মা, ফারুক, সৌমিক-সব নাম্বারে ডায়াল করেন। কারওটা ব্যস্ত, কারও ফোনে ‘দুঃখিত এই মুহূর্তে সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না’। অজানা আশঙ্কায় কুঁকড়ে ওঠেন। বুকের ভেতর কেমন জানি করে ওঠে। ডায়াল চাপতে থাকেন পাগলের মতো। খুব ইচ্ছে হচ্ছে জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দিতে দামি স্মার্টফোন দুটো। অর্থহীন মনে হচ্ছে দুনিয়াটাকে। ব্যবসা, জরুরি মিটিং, রপ্তানি অর্ডার-কত কিছুই মাথা থেকে উবে যাচ্ছে ধোঁয়া হয়ে, ঠিক বুঝতে পারছেন সেকান্দার সাহেব। বুকের চিনচিনে ব্যথাটা বাড়তে থাকে। দ্রুত হাতব্যাগ হাতড়ে জিবের নিচে স্প্রে করেন। পথ যেন আর ফুরোয় না।
লাইফটাইম হাসপাতালে এসে যখন পৌঁছান সেকান্দার সাহেব, সন্ধ্যা গড়িয়ে আঁধার নেমেছে। বারিধারার অত্যাধুনিক এই হাসপাতালের অপারেশন থিয়েটারের সামনে কতগুলো নির্বাক মুখ। শঙ্কাচ্ছন্ন এই মানুষগুলোকে বড় অচেনা মনে হতে থাকে সেকান্দার সাহেবের। ছুটে এসে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন শ্যামলী নাসরীন।
কী হয়েছে আমার উমামার? অপারেশন থিয়েটারের সামনের লনেই সংজ্ঞা হারান সেকান্দার সাহেব।
বেলা ঠিক দুটোয় স্কুল ছুটি হয় উমামার। গুলশানের বাসা থেকে আনা-নেওয়া করে প্রায় দেড় যুগের বিশ্বস্ত গাড়িচালক কবির। নিয়ম করে সকাল ৮টায় বের হয়। দুটোয় বেরিয়ে কোনো দিন তিনটা বা সাড়ে তিনটায় বাসায় ফেরে। বেশির ভাগ দিন মেয়েকে স্কুলে দিয়ে নিজের কাজে বেরিয়ে পড়েন শ্যামলী নাসরীন। ইহান ধানমন্ডির ম্যাপল লিফ এ পড়ে। তাকে নিয়েও ব্যস্ততা কম যায় না শ্যামলী নাসরীনের। ব্যবসার কারণে সেকান্দার খুব ব্যস্ত থাকেন বলে এই আনা-নেওয়ার কাজটা হয় স্ত্রী, না হয় ড্রাইভার কবিরকে দিয়ে করান।
স্কলাসটিকার প্লে গ্রুপে মর্নিং শিফটের সবার প্রিয় মুখ উমামা। ক্লাসের আর দশজন স্কুলড্রেসের বাচ্চাদের থেকে সহজেই খুঁজে নেওয়া যায় তাকে। কালো জ্বলজ্বলে বড় চোখ। মাথার বড় চুলের ঝুঁটি। হাসি ঝুলে থাকা মুখ। ক্লাসটিচারদেরও খুব প্রিয় আর আদরের উমামা। স্কুল শেষে তাইতো বেশির ভাগ সময়ই কোনো কোনো টিচার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দেন উমামাকে।
দুটোর দশ মিনিট আগে কবিরকে ফোন করেছিলেন শ্যামলী নাসরীন। আর আড়াইটায় ফোন এল অপরিচিত নম্বর থেকে।
হ্যালো, শ্যামলী নাসরীন বলছেন?
জি বলছি।
লাইফটাইম হাসপাতাল থেকে বলছি।
বুকটা ধড়াস করে ওঠে শ্যামলী নাসরীনের। জি বলুন।
জি ম্যাডাম, আসলে…খারাপ খবর আছে। আপনার গাড়িটা খিলক্ষেতে অ্যাকসিডেন্ট করেছিল…
চারপাশে অন্ধকার দেখতে থাকেন শ্যামলী নাসরীন। মনে হয়, মাথা ঘুরে এখনই পড়ে যাবেন। অনেক কষ্টে সামলে নেন নিজেকে।
আপনার ড্রাইভারকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। আপনার মেয়ের ব্যাগে ইমার্জেন্সি নম্বর ছিল আপনার। সেখান থেকে ফোন করলাম। প্লিজ, আসুন।
হাত থেকে রিসিভার পড়ে গেল। উদ্ভ্রান্তের মতো হাসপাতালে ছুটলেন শ্যামলী নাসরীন।
টানা ৫ ঘণ্টার চেষ্টাতেও বাঁচানো গেল না উমামাকে। সরি।
অপারেশন থিয়েটার-ফেরত ডাক্তারদের সিনিয়র মাথা নিচু করে এ কথা বলেই চলে গেলেন।
কেঁদে উঠল আকাশ-বাতাস। দপ করে যেন আজ নিভে গেল সব আলো। হাসিমুখগুলো যেন হারিয়ে গেল মেঘেদের দেশে। চারপাশে শুধু হাহাকার, শূন্যতা। হাসপাতালের কাচঘেরা দেয়াল ভেদ করে কান্নার ঢেউ এসে মিশে গেল জনসমুদ্রে।
সেই জনসমুদ্রের ভিড়ে ছুটে চলেছেন সেকান্দার সাহেব। হাতে এক তোড়া ফুল, বুকপকেটে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা চিঠি। কিছুতেই ধরতে পারছেন না উমামাকে। খিলখিলিয়ে হেসে ছুটে চলেছে নগরীর অলিতে-গলিতে। পেছন পেছন ছুটছেন সেকান্দার সাহেব। আজ যে উমামার জন্মদিন।
উমামা থাকলে আজ পাঁচে পা দিত। সেই দুপুরের পর বেরিয়ে দোকানে দোকানে ঘুরে উমামার জন্য জামা কিনেছেন সেকান্দার সাহেব। ফুল কিনেছেন। পাঁচ পাউন্ডের কেক কিনেছেন। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে ড্রয়িংরুমে সব সাজিয়েছেন। মোমবাতি জ্বলেছে। তারপর ডুকরে কেঁদেছেন। পরিবারের সবাই কেঁদেছে। আজ যে বেদনার দিন। সব হারানোর দিন।
কিন্তু এখন মনটা ভালো সেকান্দার সাহেবের। উমামা ফিরে এসেছে। সেই যে বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে, কিছুতেই ছাড়ছে না। আবার নিজেই নেমে সারা ঘর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ঘরের কোণে সযতেœ সাজিয়ে রাখা খেলনাগুলো নিয়ে দুর্বার খেলছে। বড় ভালো লাগছে সেকান্দার সাহেবের। এ ভালো লাগার মূল্য যে কতটা, যার ভালো লাগা নেই সেই তো বুঝতে পারে।
রাত ক্রমশ বাড়তে থাকে। ঝিরিঝিরি বাতাসে হলদে আভায় ছেয়ে ওঠে পুবাকাশ। টেবিলে মুখ গুঁজে উমামাকে প্রাণভরে দেখতে থাকেন সেকান্দার সাহেব। উমামা এগিয়ে এসে হাত বুলিয়ে দিতে থাকে মাথায়। বাহুতে শক্ত করে মেয়েকে জড়িয়ে রাখেন। ছোট্ট তুলতুলে মুখে হাত বুলিয়ে দেন। বহুদিন পর আজ কানায় কানায় ভরে ওঠে সেকান্দার সাহেবের এই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট। এত সুখ আর অনাবিল শান্তি যেন এক স্বপ্নের বাগানে ছুটে চলেছেন অবিরাম। ছোট্ট হাতে বাবার মাথায় বিলি কাটতে থাকে পরি। সেকান্দার সাহেব তলিয়ে যেতে থাকেন গভীর ঘুমের রাজ্যে।
শেয়ার করুনঃ