আমি এমন কোনো সফল মানুষ নই যে আমার জীবন নিয়ে কিছু বলতে পারি। তার পরও আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানে আমাকে ডাকায় আপনাদের ধন্যবাদ, মাননীয় সভাপতি।
লোকটার বয়স এখনো পঞ্চাশ হয়নি। অথচ প্রিন্সিপাল স্যার তাকে নিয়ে এসেছেন বক্তৃতা দিতে। এই বিষয়টি কলেজের দেড়শো শিক্ষার্থীর কাছে এক বিস্ময়। এমন নানা ধরনের বিস্ময় তারা নিয়মিত পায় নতুন প্রিন্সিপাল কাজে যোগ দেওয়ার পর। মোহনপুর আদর্শ কলেজের নতুন প্রিন্সিপালের নাম এম রহমান। মুরাদ রহমানের সংক্ষিপ্ত রূপ। ভিজিটিং কার্ডে অবশ্য নামের শেষে এমএ লেখা আছে। এম রহমান এমএ।
এম রহমানের আগে এই কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন তার দাদা মাইদুল রহমান। তিনি পরিচিত ছিলেন এম রহমান নামে। আশপাশের দশগ্রামের সবাই তাকে এম রহমান স্যার নামে জানত। তিনি মারা গেছেন তিন বছর আগে। মারা যান প্রিন্সিপালের চেয়ারে বসেই। সবাই ভেবেছিল, অনেক কাজ আছে তাই প্রিন্সিপাল স্যার চেয়ারে বসে আছেন। শেষে সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নামতেই এগিয়ে যায় দপ্তরি হরিপদ। তার তখন বাড়ি যাওয়ার তাগাদা। দেরি করে ঘরে ফিরলে বউ অনেক জ্বালাতন করে। ভাত তো গরম করেই না, কড়কড়া ভাতও কপালে জুটে না। ভাতে পানি দিয়ে রাখে। কাজেই সন্ধ্যা হলে তার ঘরে ফেরা পাখিদের নীড়ে ফেরার মতোই দরকারি।
হরিপদ ভয়ে ভয়ে এগিয়ে যায়। দেখে চেয়ারে বসে আছে এম রহমান স্যার। মুখটা হা করে খোলা। তা দিয়ে বাতাস নেওয়ার কোনো শব্দ নেই। অথচ দিনভর শ্বাস টানার একটা শোঁ শোঁ শব্দ পাওয়া যেত তার কাছে যেতেই। হা করা মুখের সামনে উড়ছে একটা মাছি। বেশ বড় দেখতে সেটা। চোখগুলো সবুজ। এমন মাছি জীবনে খুব একটা দেখেনি হরিপদ। সে কাছে যায় । হাতপাখা দিয়ে মাছি সরায়। বলে, হিস মাছি, হিস।
তাতে মাছি সরে। একটা গুনগুন শব্দ হয়। তাতে অবশ্য শ্বাসের শব্দ পাওয়া যায় না।
স্যার, সইন্ধ্যা হইছে।
এম রহমান কোনো শব্দ করেন না।
স্যার, আপনে কিছু খাইবেন?
এম রহমান কোনো শব্দ করেন না।
হিস মাছি, হিস। মাছি সরাতে গিয়ে আরও কাছে যায় হরিপদ। তখনই সন্দেহ হয় তার। নাকের কাছে হাত নিয়ে দেখে শ্বাস নাই। না, লোকটা তখন আর নাই। লোকটার ভেতরের বিদ্বান মানুষটা আর নাই। একটা দেহ পড়ে থাকল চেয়ারে। লোকটাকে মাটির নিচে ধর্মমতে রেখে এলেও গ্রামের লোকেরা একে অন্যের সঙ্গে সুলায়মান নবীর গল্প বলা শুরু করে। মৃত্যুর পরও তিনি লাঠিতে ভর করে দাঁড়িয়ে ছিলেন হাজার বছর। লোকজন বলল, তখন তিনি তদারকি করছিলেন মসজিদ নির্মাণের। জিন ও মানুষ মিলে বানাচ্ছিল তা। শেষে ঘুণ পোকায় খেয়ে নেয় লাঠি। ধপাস করে পড়ে যান নবী। লোকজন বলল, কী চমৎকার মৃত্যু তার। একদম নবীর মতন মৃত্যু। আহা রে, লোকটা সারা জীবন শেষ করল মানুষকে বিদ্বান বানাতে। এর কী সুন্দর প্রতিদান পৃথিবী থেকেই পাওয়া শুরু হলো তার। সবাই এম রহমানের প্রতি সম্মান জানিয়ে তার নাতি মুরাদ রহমানকে কলেজের প্রিন্সিপাল বানিয়ে দিল। দাদার প্রতি সম্মান জানিয়ে মুরাদ রহমান নিজের নাম ছোট করে বানাল এম রহমান। কাজে যোগ দিয়ে বলল, ব্রিটিশ রাজত্বে রাজা মরে না। মানে রাজার সিংহাসনে বসে আছেন, এমন এক ব্যক্তি মারা গেলে আরেক ব্যক্তি রাজা হন। আমাদের আদর্শ কলেজেও এম রহমান স্যার মরেন নাই। এম রহমান সিনিয়র চলে গেছেন এই পৃথিবী থেকে। কিন্তু আমি নিজের নাম মুরাদ রহমান এমএ ছোট করে রাখলাম এম রহমান।
এটা নাকি বিদেশি নিয়ম। অহরহ লোকের নাম হয় সিনিয়র-জুনিয়র দিয়ে। বিদেশি আরও নানা সিস্টেম চালু করলেন নতুন এম রহমান। তাতে গত বছর পরীক্ষার রেজাল্ট হয়েছে ভালো। একজন বোর্ডে মেধাতালিকায় স্থান পেয়েছে। তাকে সবার সামনে এক পাল্লায় বসিয়ে আরেক পাল্লায় বই তুলে উপহার দিয়েছেন এম রহমান স্যার। ছেলেটার ওজন ছিল ৫০ কেজি। কলেজ লাইব্রেরির অনেক বই সেদিন দখলে নেয় ছেলেটি।
এম রহমান স্যারের আরেক খেয়াল মানুষ দাওয়াত দিয়ে আনা। তারা এসে জানায় সাফল্য। মানে নিজের জীবনের নানা গল্প বলে। ছাত্ররা তাতে বেশ মজা পায়। অনেকটা ছোটবেলার দাদা-নানির কাছে কিচ্ছা শোনার মতন। এই তো গত মাসে এলেন এক ব্যবসায়ী, দেখতে যেন মাদ্রাসার ইমাম। বললেন, ঘুষ না দিলে কাজ হয় না। তারপর ঘুষের নানা অপকারিতা। ছাত্রদের সেসব খুব একটা মনে ধরেনি। ভালো লেগেছে দুই বন্দীর গল্প। গল্পচ্ছলে বললেও তা ঠিক গল্প নয়, বাস্তব। ঘটনা ছাপা হয়েছে পত্রিকায়। প্রেমকাহিনি বলে বেশি ভালো পছন্দ হয় ছাত্রদের। ছেলেটি ও মেয়েটির প্রথম দেখা হয় মহানগর আদালত চত্বরে। দুজনই পুলিশের হাতে বিভিন্ন অপরাধে আটক। আদালতে হাজির করা হয়েছে পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। হয় জামিন, না হয় সাজা, না হয় আরেক তারিখে হাজির করার নির্দেশ। কোমরে রশি, হাতে হাতকড়া। চোখ তো আর বন্ধ নয়। দুজন দেখে দুজনকে। আর প্রথম দেখাতেই প্রেম। আদালতে হাজির করার আগে রাখা হয় এক ঘরে। এ মাথায় ছেলেটি ও মাথায় মেয়েটি। তখনই কথা বলে তাদের চোখ। বুঝে নেয় একে অন্যের মনের কথা। এই প্রেমের মাঝে এল ঘুষ। লেনদেন হলো সন্তর্পণে। কনস্টেবলের সহায়তায় দুজনের দেখা হলো বাথরুমে। প্রেমের গল্প এখানেই শেষ নয়। জেলেই বোঝা গেল লক্ষণ। মা হবে মেয়েটি। জামিনে ছাড়াও পেল। জামিনে ছাড়া পেল ছেলেটি। কিন্তু বিয়ে তো দূরের কথা, মেয়েটির সঙ্গে প্রেমের কথা স্বীকারই করল না ছেলেটি। মেয়েটা কী আর করে, ঘুরে বেড়ায় এখানে-সেখানে। যায় এর কাছে, ওর কাছে। অধিকার আর আসে না। আরও অনেক কথাই বলেছিল লোকটি। কিন্তু এই লোক কী বলবে, তা আঁচ করতে পারে না আদর্শ কলেজের ছেলেরা।
লোকটি গলা খাঁকারি দেয়। পানির গ্লাস থেকে শুষে নেয় তরলটুকু। চাঙা হয়ে বলতে শুরু করে-আমার নাম মাহমুদুল ইসলাম। ইচ্ছে ছিল সরকারি চাকরি করব। মানে বিসিএস করে শেষ বয়সে সচিব হব। সচিব যদি হয় বটগাছ, তবে কলেজ লাইফ হলো সে গাছ লাগানোর সময়। মানে উপযুক্ত সময়। সেটা আমি জানতাম। শুধু জানতাম না, কিছু না থেকে মানুষের জীবনে অনেক কিছু হতে পারে। সে অনেক কিছু অনেক সময় আনন্দের হয়, আবার অনেক সময় আনন্দের হয় না। এটাই আজকের আমার বলার বিষয়। যাহোক, আমি যেহেতু কলেজ লাইফেই জানতাম বীজ বুনেছি, কাজেই আমার প্রস্তুতি ছিল। পরীক্ষার ফল ভালো করার তুমুল আগ্রহও ছিল। আমি জানতাম, কলেজে ভালো ফল না করলে ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পারব না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফল না করলে বিসিএসে ভালো করব না। বিসিএস এ ভালো না করলে এডমিন ক্যাডার পাব না। কাজেই আমার পড়ালেখায় মনোযোগের কোনো ঘাটতি ছিল না। আমি যথারীতি বিশ্ববিদ্যালয় পাস করলাম। এমনকি বসে না থেকে একটা চাকরিও জুটিয়ে নিলাম। তাতে ঢাকায় থাকা সহজ হলো, আবার মাস শেষে হাতে কিছু টাকাও আসতে লাগল।
কথাগুলো বলে মাহমুদ সাহেব একটু থামেন। পানি পান করেন কয়েক ঢোঁক। দেখে হলঘরে পিনপতন নীরবতা। এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা সে বলেনি যাতে এই নীরবতা আসতে পারে। বোঝা গেল, এরই মধ্যে ছাত্রদের ভালো শ্রোতা হাওয়ার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা কাজ করছে প্রিন্সিপালের চিন্তামতো। হতে পারে তা মনোযোগ দেওয়ার অভিনয়। অভিনয় না বাস্তবতা কে দেখতে আসছে। তার কাজ নিজের জীবন নিয়ে কিছু বলা। তিনি বলতে শুরু করলেন- তো কিছু টাকা হাতে এলে আমাদের বাবা-মায়েদের মাথা ঠিক থাকে না। জীবন যে একটা চাকরিতেই শেষ হয়ে যায় না, তা তারা বুঝতে চান না। তারা মনে করেন, চাকরি একটা হলেই হলো। কিন্তু নিজের কাক্সিক্ষত চাকরিটি না পাওয়া পর্যন্ত মানুষ যে সফল হয় না, তা তারা বুঝতে চান না। আমার বাবা-মাও বুঝতে চাইলেন না। আমি যতই বলি, মনের মতো চাকরি হোক, সরকারি চাকরি পাই আগে, তারপর বিয়ে, তারা ততই বলতে থাকেন, বেসরকারি চাকরিজীবীরা কি বিয়ে করে না?
হলরুমের এ মাথা থেকে ও মাথায় একটা হাসির হিল্লোল বয়ে গেল। কেউ কেউ মুখরিত হাততালিতে। মেয়েদের অনেকেরই নাকের ওপর ঘাম, গাল হলো লাল। বিয়ের মানে এই বয়সেই তাদের অনেকেই জানে। ছেলেদের কাছে তা এখনো একটা উন্মাদনা মাত্র। প্রকৃতির সূক্ষ্ম পার্থক্য আচমকা মনে ধরল মাহমুদের। তাতে সে কিছুটা বিচলিত হলো।
যাহোক, কথা যা-ই বলি, যুক্তি যা-ই দেই, কোনো কিছুতে কোনো কাজ হলো না। আমার বিয়ের দিন-তারিখ ঠিক হয়ে গেল। টাকাপয়সা আটকাল না। বাবা নিজেই জমানো টাকা ভেঙে বিয়ের আয়োজন করলেন। আমি চুপি চুপি একটা হীরার নাকফুল কিনে নিলাম বউকে উপহার দেব বলে। অমত করি আর মত, যা-ই করি না কেন, নতুন বউ দেখে মনে আওড়ালাম রবীন্দ্রনাথের সেই কথা, আমি তাহাকে পাইলাম। এ আমার সম্পত্তি নয়, সম্পদ।
এবার দারুণ হাততালি পড়ল হলরুমে। তাতে ভয় পেয়ে জানালার কার্নিশ থেকে উড়ে পালাল এক জোড়া কবুতর। সেই শব্দে চমকে উড়ে গেল একটা চড়ুই। সেটা নেমেছিল মাটি খুঁটিয়ে কিছু একটা পেতে। সেই মাটির রং অবশ্য ঢাকা আছে সবুজ ঘাসে। সেই ঘাস শেষ হয়েছে পুকুরের পানির কাছে এসে। পানির রংও শ্যাওলার উপস্থিতিতে সবুজ। চুন দিয়ে তা পরিষ্কার করতে হবে। মাছ চাষের বুদ্ধি এখনো নতুন প্রিন্সিপালের মাথায় আসেনি বলে তাতে চাষ শুরু হয়নি। আগের প্রিন্সিপাল টাকা কামানোর চেয়ে জ্ঞান বিতরণকেই বেশি গুরুত্ব দিতেন কিনা। অবশ্য তাতেও লাভ হয় নাই। তার আমলে ছেলেরা ভালো ফল করে নাই। আবার পুকুরেও মাছ চাষ করে নাই। কেবল এই দুপুরেও সেই পুকুরে পোঁতা একটা লাঠির মাথায় বসে থাকে একটা মাছরাঙা।
হাততালি শেষ হলে মাহমুদুর বুঝতে পারে, শ্রোতাদের বয়স অল্প। তাই এমন একটা সংলাপে নড়ে উঠেছে তাদের ভেতরটা। তিনি জীবনের যে কঠিন উপলব্ধি বলতে এসেছেন, তা তারা কীভাবে নেবে একপলক বোঝার চেষ্টা করলেন। তারপর ভাবলেন, বোঝাবুঝির কিছু নাই। তার কাজ বলা, সুতরাং গল্প বলে শেষ করা উচিত। মানে জীবনের কথাটি গল্পের ছলে বলা উচিত।
যা বলছিলাম। শুরু করে মাহমুদ। নতুন বউ ভালো লাগে। শাড়িতে ভালো লাগে, চুড়ির শব্দে ভালো লাগে, অলস দুপুরে যখন কথা বলতে বলতে হাই তুলে, দেখি ভালো লাগে।
হাসির ঢেউ আবারও বয়ে গেল হলরুমে।
তো, বউ নিয়ে ফুচকা খাই, ঘুরতে যাই। চাকরি করি, বই পড়ি। স্বপন দেখি সরকারি চাকরির। তখন একদিন ঘটনাটি ঘটে। তাতে আমার জীবন বদলে যায়। আমি বুঝতে পারি, পৃথিবীতে এমন অনেক সময় আসে যখন কিছু না থেকে অনেক কিছু হতে পারে। মানে ফ্রম নাথিং সামথিং জয়ফুল অর ডেঞ্জারাস ক্যান হ্যাপেন। মানে, কিছুই না একদম অস্তিত্বহীন কোনো ঘটনা থেকে বিশাল কিছু হতে পারে। সে কথাটি বলব আজ। সবাইকে অনুরোধ করব খুব মনোযোগ দিয়ে শুনতে। এমন ঘটনা আমাদের যে কারও জীবনে হতে পারে। শতকরা হিসাবে তা যদি শতকরা এক ভাগ মানুষের জীবনে হয়, তবে তা যার জীবনে হলো তার জন্যে কিন্তু শতভাগ। কাজেই সাবধান। ঘটনার শুরু সেদিন বিকালে। আমি অফিস থেকে ফিরতেই বউ বলল, নিউ মার্কেট যাব। আপনারা নিউ মার্কেট চিনেন তো?
ছাত্ররা এক বাক্যে বলল, চিনি। তাতে মাহমুদ নিশ্চিত হলেন, সবার মনোযোগ আছে।
আমি বললাম, গত সপ্তাহে না নিউ মার্কেট গেলে, কথা এগিয়ে নেয় মাহমুদ।
বউ বলল, সেটা তো গত সপ্তাহের ব্যাপার। সাত দিন পার হয়ে গেছে।
আজই যেতে হবে?
আজই।
কী আর করা। পড়েছি মোগলের হাতে, খানা খেতে হবে সাথে। আমি সম্মত হলাম। নিউ মার্কেট মেয়েদের জন্য একটা বাগান, মেয়েরা যেন একেকজন প্রজাপতি। এই দোকানে ওড়ে, ওই দোকানে ঘুরে। এটা কিনে, ওটা ধরে, এটা ঘষে, ওটা মুছে। ওখানে সময় থেমে গেলে বোধ হয় বাঙালি মেয়েদের চাইতে আর কেউ বেশি খুশি হতো না।
আমার জন্য সেটা আনন্দের ছিল না। একে তো সারা দিন অফিস করার ক্লান্তি, তারও পর ওর এটা-সেটা দেখে সময় নষ্ট করায় আমার বিরক্তির সীমা ছিল না।
ও বলল আকাশি টিপ নিই?
বললাম, নাও।
তাহলে যেতে হবে গাউছিয়া। এখানে আকাশি রং পাচ্ছি না।
আমরা গাউছিয়া গেলাম। আকাশি টিপও পেলাম। সাইজ মিলল। কিন্তু ফেরার পথে আমি চাইলাম সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে, আমার বউ বলল রিকশায় যাবে। আমি তাকে বোঝাতে চাইলাম, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার জন্য সিএনজির বিকল্প নেই। সে আমাকে বোঝাতে চাইল, রিকশার চেয়ে রোমান্টিক বাহন আর নেই।
হলরুমে আবারও হাসির ঢেউ বয়ে গেল।
তর্ক থামল না। রিকশা চলছে, তর্ক চলছে। পথ এগোচ্ছি, তর্কেও এগোচ্ছি। আচমকা আমার বউ রিকশা থেকে নেমে যেতে চাইল। ঠিক কোন কথা শুনে সে নেমে যেতে চেয়েছিল, এখন তা আর মনে নেই। অর্থাৎ কথাটা এতই তুচ্ছ ছিল যে সেটা আমি আর মনে রাখতে পারিনি। আমার ধারণা, সেই কথা আমার বউও মনে রাখেনি। কিন্তু ঘটনাটি আমরা কেউ চাইলেও ভুলে থাকতে পারব না। সেই ঘটনা বদলে দেয় আমাদের জীবন। টানা এক যুগের বিরহ। আমি ছিটকে পড়ি আমার জীবনের লক্ষ্য থেকে। হতে চেয়েছিলাম গাছ, হয়েছি আগাছা।
যাহোক, আমি তার হাত ধরলাম। নামতে দিতে চাই না। কে চায় তার বউ রাগ করে রিকশা থেকে নেমে যাক। কিন্তু হাত ধরতেই তার বল বেড়ে গেল অনেক সাথে রাগও। যেকোনোভাবে সে নামতে চায়। যাবে অন্য রিকশায়। যদি অন্য কোথাও যেত তাহলে একটা কথা ছিল। যাবে বাসায়, কিন্তু আমার সঙ্গে যাবে না। আমিও রেগে গেলাম। গলার স্বরে সে রাগ ফুটে উঠল। বউ চেষ্টা করছে হাত ছাড়িয়ে নিতে। তা আশপাশের মানুষের মনোযোগ কাড়ে।
রাস্তার পাশেই বেশ কিছু দোকান। আছে একটা ফাস্ট ফুডের দোকানও। সেখান থেকে বেরিয়ে এল এক তরুণ।
কী হইছে? ওই ব্যাটা হাত ছাড়।
আমি বললাম, মাস্তানি করতে আইসো না, ভাগো।
মাস্তানি মানে, ওই মেয়ের হাত ছাড়, বলেই সে আমার বউয়ের হাত ধরল।
বউ হতভম্ব। লোকটা এগিয়ে এসে আমার কলার ধরল। দিল এক ঘুষি। তাতেই আমি বউয়ের হাত ছেড়ে দিই। নামি রিকশা থেকে। এদিক-ওদিক তাকাই। দেখি, একটা শাবল পড়ে আছে ফাস্ট ফুডের দোকানের দরজার পাশে। সেটা সেখানে কে রাখল, কেন রাখল আমি জানি না। তা তুলে ঢুকিয়ে দিলাম লোকটার শরীরে।
হলরুমে নীরবতা।
লোকটা কেঁপে উঠল। তারপর সব শেষ। লোকটার জীবন, বউয়ের রাগ, আমার ভবিষ্যৎ, সব শেষ।
আমার আর কিছু বলার নেই। শুধু একটা কথা ছাড়া। কোনো কারণ ছাড়াই অনেক কিছু হয়ে যায় অনেক সময়। সাফল্যের জন্য তা এড়িয়ে চলতে হয়।
কারও কোনো প্রশ্ন?
কোনো প্রশ্ন নেই।
শেয়ার করুনঃ