জাতীয় সংসদ নিবার্চন নিয়ে সরকার ও বিরোধী দল দুই মেরুতে অবস্থান করছে। তবে অরাজনৈতিক সিটি করপোরেশন নিবার্চনই জাতীয় নিবার্চনের উত্তাপ ছড়িয়েছে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের নিবার্চন না হওয়ার কারণে, সেই উত্তাপের ঢিল ঢাকাকে আন্দোলিত করেনি। তবে রাজধানীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে উত্তাপ থেমে নেই। বরং এত দিন জাতীয় প্রেসক্লাবসহ কয়েকটি সীমিত জায়গায় এ নিয়ে আলোচনার ঢেউ আছড়ে পড়লেও সংসদে বিরোধী দলের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নতুন ভ্যেনুতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
প্রথমে চার সিটি করপোরেশন-খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল ও সিলেটে নিবার্চন । তারপর নতুন গঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশনের নিবার্চন । রাজনৈতিক মোড়কে অরাজনৈতিক এই নিবার্চন গুলো কেবল সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন এলাকার অধিবাসীদেরই আন্দোলিত করেনি; পুরো দেশকেই আন্দোলিত করেছে। এই নিবার্চন গুলো সরকারের টেস্ট কেস আর বিরোধী দলের প্রেস্টিজ ইস্যু মনে হলেও কার্যত এরই মধ্য দিয়ে জাতীয় নিবার্চনের একটি ড্রেস রিহার্সেল হয়ে গেল। রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, সিটি নিবার্চনের ঢেউ চলমান রাজনীতির ওপর জাতীয় নিবার্চনের স্বপ্নিল আবহ তৈরি করছে। দেশের মানুষও জাতীয় নিবার্চনের আগে সিটি করপোরেশন নিবার্চনের তোড়ে নিজেদের ভোটার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে শুরু করেছে।
সিটি করপোরেশন নিবার্চন অরাজনৈতিক হলেও অতীতের মতোই সরকার ও বিরোধী দল নিজেদের সমর্থিত প্রার্থীর জয় নিশ্চিত করতে আদা-জল খেয়ে প্রচারণা চালায়। নিবার্চন কমিশনের হুঁশিয়ারির কারণে, মন্ত্রিরা নিকট দূরত্বে থাকলেও মন্ত্রী নন, সরকারি দলের এমন শীর্ষ নেতারা প্রতিটি সিটি করপোরেশন এলাকায় গিয়ে মাঠ গরম করেছেন। তবে এ যাত্রায় পিছিয়ে ছিলেন না বিরোধী দলের শীর্ষ নেতারাও। কেন্দ্রীয় নেতাদের পাশে পেয়ে স্থানীয় নেতারাও দারুণ উজ্জীবিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষক, কবি ও কলামিস্ট গোলাম কাদের মনে করেন, কার্যত সিটি করপোরেশন নিবার্চনের মধ্য দিয়ে দেশে জাতীয় নিবার্চনের নতুন উন্মাদনা সৃষ্টি হলো। এই উন্মাদনায় আপাত চার কিংবা পাঁচটি সিটি করপোরেশন এলাকার অধিবাসীরা উদ্বেলিত হলেও নতুন জাতীয় সংসদ নিবার্চনের সম্ভাবনা নিয়ে দেশবাসী ভাবতে শুরু করেছেন।
সিটি করপোরেশন নিবার্চনের সিঁড়ি বেয়ে দেশে জাতীয় নিবার্চনের উত্তাপ ছড়িয়ে পড়বে; সেই নিবার্চনে দেশবাসী ঝাঁপিয়ে পড়বে-এমন সম্ভাবনা মানতে নারাজ রাজনৈতিক বিশ্লেষক এ কে এম পাটোয়ারী। তিনি বলেন, রাজনৈতিক অবস্থানগত কোনো পরিবর্তন এখনো দৃশ্যমান নয়। অবস্থা যে তিমিরে ছিল, সেখানেই রয়েছে। উন্নতি বলতে, বিরোধী দল সংসদে ফিরেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে কোনো সমঝোতার সম্ভাবনা এখনো দেখা যাচ্ছে না। এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, পরিস্থিতি আপাতত সংসদ-কেন্দ্রিক ঘুরপাক খেলেও তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে সমঝোতার কোনো পূবার্ভাস মিলছে না।
এই বিশেস্নষকের কথা আর দুই নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক বক্তব্যে স্পষ্ট মিল পাওয়া যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী দলের তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায় স্পষ্ট ঘোষণা দিয়েছেন, সংবিধানের বাইরে কোনো কিছুই হবে না। সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই; আর কোনো অনিবার্চীত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না আওয়ামী লীগ। অপর দিকে, বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্ট করে বলেছেন, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নিবার্চন দেশে হবে না; জনগণ এমন নিবার্চন হতে দেবে না। নিবার্চন অবশ্যই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হতে হবে।
আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বাস্তবায়নের কথা বলছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ বলেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া দেশের সব মানুষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার চায়। এ দাবি উপেক্ষা করার কোনো সুযোগ নেই। তিনি এক ধাপ এগিয়ে নিবার্চন কমিশন নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। এই কমিশন নিরপেক্ষতা হারিয়েছে; পুনর্গঠন জরুরি বলেও মত দিয়েছেন হান্নান শাহ। আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এলজিআরডিমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম বলেছেন, আলোচনার মধ্য দিয়ে সমাধান আসবে এবং যা কিছু হওয়ার সংবিধানের আওতায় হতে হবে। দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য মন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেছেন, আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই; সংবিধানের বাইরে কোনো কিছু হবে না।
এই বাস্ত্মবতায় রাজনীতিতে সংলাপের সম্ভাবনা দূরে সরে গেছে। তবে এখন রাজপথের পাশাপাশি উত্তাপ ছড়াচ্ছে জাতীয় সংসদ। ৮৩ দিন সংসদের বাইরে থাকার পর বিরোধী দল সংসদ অধিবেশনে ফিরে আসায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে সংসদ। প্রতিদিনই সংসদ নানা ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। বেশির ভাগ সময় সংসদ সদস্যদের বক্তব্য শালীনতার মধ্যে থাকলেও কখনো কখনো সীমা অতিক্রম করছে। সংসদে সভা-সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা, বাজেটের পক্ষে-বিপক্ষে বিতর্ক হওয়ায় এরই মধ্যে সাধারণ মানুষের দৃষ্টি নিবদ্ধ হতে শুরু করেছে। শুরু থেকে টানা বিরোধী দলের অবস্থানকে স্বাগত জানাচ্ছে মানুষ।
সংসদেও এই বাস্তবতা কত দূর যাবে, এ নিয়ে সবর্মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে। সাবেক মন্ত্রী ব্যারিস্টার নাজমুল হুদা বলেছেন, রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে বিরোধী দল সংসদে থাকবে কিংবা বেরিয়ে যাবে। বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হায়দার আলী মনে করেন, সরকারের আচরণে সহনশীলতা থাকলে এবং স্পিকার ড. শিরীন শারমীন চৌধুরী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করলে পুরো অধিবেশনেই সরব থাকবে বিরোধী দল। তিনি বলেন, শুরুতে সরকারের মনোভাব ইতিবাচক মনে হলেও কত দিন তা থাকবে, সেটাই দেখার বিষয়।
অপর দিকে, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য ওয়ারেসাত হোসেন বেলাল মনে করেন, বিরোধী দলকে সংসদে রাখতে সরকার সর্বোর্চ্চ ছাড় দেবে। তবে তারা যদি পরিকল্পিতভাবে বের হয়ে যেতে চায়, তাহলে তো কেউ আটকে রাখতে পারবে না। জাতীয় সংসদের হুইপ আ স ম ফিরোজ বলেছেন, সরকার আন্তরিক; নতুন স্পিকার সহনশীল; এর পরও বিরোধী দল সংসদ থেকে বেরিয়ে গেলে তা হবে বিরোধী দলের জন্যই। তবে সাবেক সচিব ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান ড. আবদুল মজিদ বলেন, সংসদে যতক্ষণ বিরোধী দলকে রাখা যাবে, ততক্ষণই সরকার নিরাপদে থাকবে। এই পরিস্থিতির ব্যত্যয় হলে সংসদ প্রাণ হারাবে, রাজপথে উত্তাপ ছড়াবে।
নির্বাচনী কৌশলী লড়াইয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ হারতে চায় না। ‘কঠিনেরে আমি বাসিয়াছি’-মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে দুই বছর আগেই তারা চ্যালেঞ্জ নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুকে সংবিধানের পবিত্র দলিল থেকে সংসদের মাধ্যমে গুডবাই জানিয়েছে। সেই চ্যালেঞ্জ নিজেদের কতটা এগিয়েছে, আর বিরোধী দলকে কতটা বেকায়দায় ফেলেছে-এই মুহূর্তেই মিলছে তার পোড়া কাষ্ঠ। তবে প্রতীক্ষার প্রহর গুনতে শুরু করেছে জাতি-শেষ পযর্ন্ত উজানের পানি কোথায় গিয়ে পড়ে?
মাহমুদ আল ফয়সাল
হেড অব নিউজ, মাই টিভি
শেয়ার করুনঃ