একজন মানুষ যখন কোন রোগে আক্রান্ত হয় তখন তিনি স্বাভাবিকভাবে চিকিৎসকের সরনাপন্ন হন। চিকিৎসক রোগ নির্ণয় করে সেই রোগীকে দেন প্রয়োজনীয় ঔষুধ। রোগী রোগ সারাতে ফার্মেসিতে গিয়ে কিনে নেন ঔষুধ। কিন্তু রোগীকে বোকা বানিয়ে ফার্মেসিগুলো দিয়ে দেন মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষুধ। সেই মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষুধ খেয়ে রোগী ভাল হওয়ার পরিবর্তে আরও অসুস্থ হয়ে পড়েন। কখনো কখনো মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ খাওয়ার কারণে মৃত্যুর মুখেও পতিত হন। দু:খজনক হলেও এটা আমাদের দেশের বাস্তবতা। সেই বাস্তবতা আরও সামনে আসে যখন স্বয়ং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা বাজারে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ আছে বলে তথ্য দেন। প্রায় সাড়ে তিন মাস পূর্বে গত ১০ জুন সবার সামনে পুরনো বিষয়টি নতুুন করে নিয়ে আসেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ার। তিনি সেদিন বলেছিলেন, রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রি হয়। নিয়মিত বাজার তদারকির ছয় মাসের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে তিনি এ মন্তব্য করেছিলেন। শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর এই শহর মানে রাজধানীর ফার্মেসিগুলোর যখন এমন অবস্থা তখন সারা দেশের ফার্মেসিগুলোতে কত ধরনের অনিয়ম হয়ে থাকে, তা সহজেই অনুমান করা যায়।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মঞ্জুর মোহাম্মদ শাহরিয়ারের এমন মন্তব্যের পর গত ১৮ জুন হাইকোর্ট একটি আদেশ দিয়েছিলেন। যেখানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ এক মাসের মধ্যে বাজার থেকে জব্দ ও ধ্বংস করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। পাশাপাশি এসব ওষুধ বিক্রি, সরবরাহ ও সংরক্ষণে জড়িতদের শনাক্ত করতে কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল। আদেশ বাস্তবায়ন করে স্বাস্থ্য সচিব এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহা-পরিচালককে ৩০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলেছিলেন আদালত। কিন্তু এর প্রায় কয়েক মাস পার হলেও এ বিষয়ে কোন আগ্রগতি চোখে পড়েনি। উল্টো কয়েকদিন পর পরই দেশের বিভিন্ন স্থানে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির খবর আমাদের সামনে অস্বস্তির খবর হিসেবে আসে।
এবার একুট পেছনে ফিরে তাকানো যাক। আমাদের দেশে সব সময়ই একটি আলোচিত বিষয় হলো খাদ্যে ভেজালের বিষয়টি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমরা সেভাবে সবসময় সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখি না। কারণ আমাদের সমাজে খাদ্যে ভেজাল দেয়া এখন নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাড়িয়েছে। আমরা কেউ নিশ্চিত হয়ে বলতে পারবো না, প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি তা কতটা নিরাপদ। কারণ ভেজাল খাদ্যে বাজার সয়লাব। নিজের কষ্টের টাকায় আমরা মহাআনন্দে পরিবারের জন্য বিষ কিনে নিয়ে যাচ্ছি প্রায় প্রতিদিন। বাস্তবতা হলো আমাদের বিষ কিনে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। কারণ কোনটা যে ভেজাল মুক্ত খাদ্য তা নির্ণয় করাও কঠিন হয়ে পরছে সবার জন্য। অনেকে বিষয়টি সম্পর্কে অবগত কিন্তু উদরপূর্তির তো করতে হবে। তাই জেনেও বিষ খেতে বাধ্য হচ্ছে মানুষ। আমরা প্রতিদিন যেসব ভেজাল জিনিস খাচ্ছি তার তালিকা নেহায়ত ছোট নয়। সহজ কথায় প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে ঘুমাতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা কোনো না কোনো ভেজাল খাদ্য গ্রহণ করছি। শাকসবজি, মাছ-মাংস, দুধ, মশলা থেকে ফলমূল ও নিত্য প্রয়োজনীয় প্রায় সব খাদ্যে যেন ভেজালই এখন অনিবার্য। কেউ যদি মনে করেন এসব ভেজাল খাদ্য খেয়ে অসুস্থ হলে ওষুধ খেয়ে সুস্থ হবেন, সেখানেও অপেক্ষা করছে ভয়ানক বিপদ। কারণ ভেজালের তালিকায় বাদ নেই জীবনদায়ী ওষুধও। যা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের জন্য সত্যিই ভয়ঙ্কর খবর। দু:খজনক হলেও সত্য শহর থেকে শুরু করে গ্রামগঞ্জে মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধের ছড়াছড়ি। অক্ষরজ্ঞানহীন মানুষজন না জেনে এসব মরন জিনিস কিনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিকারের আশায়। উল্টো প্রতিকার না হয়ে, ধাবিত হচ্ছে মৃত্যুর কোলে।
আমাদের কাছে সারা দেশে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির বিষয়টি নতুন নয়, অনেক পুরনো এবং বহুল আলোচিত। এ প্রেক্ষাপটে এসব প্রতিরোধে যাদের দায়িত্ব পালনের কথা, তাদের ভূমিকা সবসময় ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। এখনও তেমন। মূলত তাদের গাফিলতির কারণে মেয়াদোর্ত্তীণ ওষুধে সয়লাব হয়ে যাচ্ছে বাজার। এটাও সত্যি একজন ক্রেতার মেয়াদ ভালোভাবে যাচাই করে ওষুধ ক্রয় করা উচিত। তবে অনেক সময় তাড়াহুড়ো করার কারণে তা দেখা হয় না। আবার কোনো কোনো ওষুধের মোড়কসহ যেসব জায়গায় মেয়াদের উল্লেখ রয়েছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা থাকে অস্পষ্ট। আবার এমনও অভিযোগ রয়েছে মেয়াদ আছে এমন প্যাকেটে মেয়াদোর্ত্তীণ ওষুধ রেখে বিক্রি করা হয়। সরল বিশ্বাসে ক্রেতারা তা দেখেন না। অসাধু ব্যবসায়ীরা এ সুযোগটি নিয়ে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণা করছেন। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি ভোক্তভুগী দরিদ্র মানুষ। ফার্মেসির কর্মচারীরা দরিদ্র রোগীর সঙ্গে প্রতারণা করেন তারা এটা বুঝতে অক্ষম বলে। যেহেতু বলা হচ্ছে রাজধানীর ৯৩ শতাংশ ফার্মেসিতে মেয়াদোত্তীর্ণ ঔষধ বিক্রি হয়। আমরা জানি যারা রাজধানীতে বসবাস করেন তাদের অধিকাংশ শিক্ষিত ও সচেতন মানুষ। শিক্ষিত ও অনেকটা সচেতন মানুষের সঙ্গে যখন এমনটা করা হচ্ছে সেখানে গ্রামের মানুষের সঙ্গে কি অবস্থা তা সহজেই অনুমেয়।
অথচ, আমাদের দেশে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫ (গ)-এর ১ (ঙ) ধারায় খাদ্য এবং ওষুধে ভেজাল মেশালে বা বিক্রি করলে অপরাধী ব্যক্তির মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা ১৪ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। আইনের খাতায় এমন শাস্তির বিধান থাকলেও আমরা কখনো শুনিনি খাদ্যে ভেজাল বা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির অপরাধে কারো মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হয়েছে। আমরা মাঝে মাঝে যা দেখি তা হলো মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে ভেজালকারীকে আর্থিক দ- দেয়া হয়। জরিমানার অঙ্কাটা এতটাই কম হয় যে, অপরাধী তাৎক্ষণিক সেই টাকা পরিশোধ করে কিছুদিন বিরতি দিয়ে আবারও মহাআনন্দে বলা যায় প্রায় দ্বিগুণ উৎসাহে ভেজাল খাদ্য বিক্রির মহোৎসবে মেতে ওঠেন। ১৯৭৪ সালে সেই আইন হলেও বর্তমান সময়ে বিশেষ করে গত দুই যুগ ধরে এদেশে খাদ্যে ভেজাল মেশানোর মাত্রা বেড়ে গেছে আশঙ্কাজনকভাবে। দিন দিন তা হয়ে উঠছে সবার জন্য অসহনীয়। বিশেষ করে মেয়াদোর্ত্তীণ ওষুধ বিক্রির খবর আমাদের সবার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।
অবশ্য এ বিষয়ে প্রতিকার রয়েছে আমাদের হাতেই। এর জন্য প্রয়োজন অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করা। যারা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া। এছাড়া ভেজাল ও নিন্মমানের ওষুধ প্রস্তুত ও বিপণনকারীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থাও জরুরি। তা না হলে নানা কৌশলে তারা মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বিক্রির চেষ্টা সবসময় চালিয়ে যাবে। শুধু ওষুধ নয়, মেয়াদোত্তীর্ণ প্রতিটি পণ্যই ভোক্তার স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। তাই এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আরও অগ্রনী ভূমিকা নিতে হবে। সহজ কথায় এখন আদালতের নিদের্শনা বাস্তবায়ন করলেই আমরা এক্ষেত্রে প্রতিকার পেতে পারি। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া।
শেয়ার করুনঃ