ধূমপানে বিষপান। এ কথা মোটামুটি বোধসম্পন্ন মানুষ মাত্রই জানেন ও মানেন। কিন্তু তা জেনেও ব্যাপক জনগোষ্ঠী ধূমপান করে যাচ্ছেন অবলীলায়। এর মধ্যে বেশির ভাগই তরুণ বয়সে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডায় প্রথম নিকোটিনের স্বাদ নেয়। আর সেটা গড়িয়ে যায় বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত। ধীরে ধীরে বহন করে ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক রোগের, যার শেষ পরিণতি মৃত্যু। নতুন ধূমপায়ী বেশির ভাগ তরুণই মনে করেন, ধূমপান নিজেদের স্মার্টনেস বাড়িয়ে দেয়। ধোঁয়া ছেড়ে নিজেকে জাহির করেন অন্য সমবয়সী তরুণীর কাছে। এমন ভাবার জন্য অনেকটা দায়ী আমাদের মিডিয়াগুলো। এ সময়ের একটি জনপ্রিয় চ্যানেলে কয়েক বছর আগেও সিগারেটের বিজ্ঞাপনের ছিল মাতামাতি। নাসির গোল্ড সিগারেটের বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল ছিল এরকম, ‘প্রতি টান সুখ টান, মাঝে মাঝে সুঘ্রাণ। স্বাদে, গুণে, তৃপ্তিতে নিজেরই সমান’। আবার ধরা যাক নেভি সিগারেটের সেই রোমান্টিক বিজ্ঞাপনটি, ‘এক লাভার বয়কে নেভি সিগারেট টানতে দেখে প্রেমে পড়ে যান বিজ্ঞাপনের মডেল তরুণীটি। সাগরস্নানে এসে তার ডুবে যাওয়ার অভিনয়, উদ্ধার করা, পেটে চাপ দিয়ে পানি বের করা, সবকিছুই ছিল রোমান্টিকতার মাতামাতি। শেষে দুষ্টু হাসি দেয় তরুণী; লাভার বয় বলে নটি গার্ল।’ তাইতো এখনো টেপ-রেকর্ডে বেজে ওঠে ডলি সায়ন্তনীর সেই বিখ্যাত গান, ‘রংচটা জিন্সের প্যান্ট পরা। জ্বলন্ত সিগারেট ঠোঁটে ধরা।’
যুবকদের সিগারেটে আকৃষ্ট করে এভাবে ফায়দা লুটছিল কোম্পানিগুলো। পরবর্তী সময়ে ২০০৫ সালে আইন করে এসব বিজ্ঞাপন বন্ধ করা হয়। তবে বন্ধ করা যায়নি ডলি সায়ন্তনীর সেই গান কিংবা ধূমপানের দৃশ্যসংবলিত চলচ্চিত্রগুলো। এখানে আইনে রয়ে গেছে শুভঙ্করের ফাঁকি। তাই নাটক, চলচ্চিত্রসহ যেকোনো প্রচার মাধ্যমে ধূমপানের দৃশ্য প্রদর্শনে নেই কোনো বাধা। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি নাটক ও চলচ্চিত্র এবং প্রচারমাধ্যমে ধূমপানের দৃশ্য প্রদর্শন বন্ধে অনেকটাই সচেতন। ধূমপানের দৃশ্যসংবলিত নাটক ও চলচ্চিত্রের শুরুতে বিশেষ সতর্কবাণী প্রচার করা হয়। এ ছাড়া ধূমপানের কোনো দৃশ্য দেখানো হলে নির্দিষ্ট তামাক কোম্পানি থেকে আর্থিক সহযোগিতা পাননি বলে স্বীকারোক্তি প্রচারিত হয় চলচ্চিত্রটিতে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ধূমপানবিরোধী একটি আইন আছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয় বিবেচনা করে সম্প্রতি মন্ত্রিসভা এই আইনটিতে সংশোধনী এনেছে। যদিও এই আইনটি এখনো সংসদে পাস হয়নি। আইনটির খসড়া অনুযায়ী, জনসমাগম স্থান বা পাবলিক প্লেসে প্রকাশ্যে ধূমপান করলে ৫০ টাকার অর্থদণ্ড বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে জনসমাগম স্থানের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ৫০০ টাকা জরিমানা করার বিধান রাখা হয়েছে। ধূমপান ও সব ধরনের তামাকজাত পণ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০০৫ সালে প্রণীত আইনটি আরও কঠোর করতে এই সংশোধনী আনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁঞা। তবে একটি কঠোর আইন প্রণয়ন করলেই ধূমপান নিয়ন্ত্রণ কি সম্ভব হবে? এই প্রশ্ন থেকেই যায়।
এবার দেখা যাক, গত জোট সরকারের শেষ সময়ে প্রণীত ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) ২০০৫-এ কী কী বিধান রাখা হয়েছে, আর এর দুর্বলতাগুলো কী কী। আইনটির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্যের ব্যবহার জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর বিধায় এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ যেহেতু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৫৬তম সম্মেলন ‘ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল’-এ স্বাক্ষর করেছে, তাই কনভেনশন অনুযায়ী ধূমপানসহ তামাকজাত দ্রব্যের উৎপাদন, ব্যবহার ও বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণ করতে আইনটি প্রয়োজনীয়। আইনের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিধানের মধ্যে রয়েছে, পাবলিক প্লেস এবং পাবলিক পরিবহনে ধূমপান করা যাবে না। কোনো ধূমপায়ী এ বিধান না মানলে তার জন্য ৫০ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছিল। এ ছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধসংক্রান্ত একটি উল্লেখযোগ্য বিধান রয়েছে। বলা হয়েছে, কোনো সংবাদপত্র কিংবা রেডিও, টেলিভিশনে ধূমপানের বিজ্ঞাপন প্রচার করা যাবে না। এ-জাতীয় হ্যান্ডবিল বা লিফলেট বিতরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইনটিতে। এ বিধান লঙ্ঘন করলে তিন মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে এ বিধি তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি করে এমন দোকানদার বা ব্যবসায়ীর জন্য প্রযোজ্য হবে না। এ আইনের মারপ্যাঁচ রয়ে গেছে এই বিধানে। বলা হয়েছে, কোনো পাবলিক প্লেস বা পাবলিক পরিবহনের মালিক, তত্ত্বাবধায়ক বা নিয়ন্ত্রণকারী বা ব্যবস্থাপক ধূমপানের জন্য কোনো স্থান নির্দিষ্ট করে দিতে পারবেন। অর্থাৎ আইনের বলয়ে চায়ের দোকানের মতো জায়গায় ধূমপান বৈধ করে দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া তামাকজাত দ্রব্যের মোড়কে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত সতর্কবাণী রাখার বিধান রাখা হয়েছে। মোড়কের মোট অংশের ৩০ ভাগ জায়গাজুড়ে এই আইনে নির্দিষ্ট যেকোনো একটি সতর্কবাণী থাকতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে ‘ধূমপান মৃত্যু ঘটায়’ বা ‘ধূমপানের কারণে স্ট্রোক হয়’ বা ‘ধূমপান ফুসফুসের ক্যান্সারসহ শ্বাসপ্রশ্বাসের কারণ’ কিংবা ‘ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর’। এ বিধি লঙ্ঘন করলে তিন মাস পর্যন্ত বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা এক হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইন বলছে, এটি একটি আমলযোগ্য অপরাধ, কিন্তু আবার জামিনযোগ্য। আর এর বিচার করা হবে কোড অব ক্রিমিনাল প্রসিডিউর বা ফৌজদারি বিধি মোতাবেক। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেটসহ যেকোনো ধরনের ম্যাজিস্ট্রেট এ আইনে বিচার করতে পারবেন।
গত বিএনপি জোট সরকারের করা এ আইন কিছুটা প্রয়োগ হয় বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। ওই সময়ে রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে ধূমপানের অপরাধে প্রায়ই অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার ফলে কিছুটা সচেতনতা তৈরি হয়েছিল। লোকজনও অনেকটাই প্রকাশ্যে ধূমপান থেকে বিরত থাকত। ওই সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া প্রথম চব্বিশ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেলে আদালত চত্বরে ধূমপান নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রচারিত হয়। প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, যে আদালত আইনের প্রয়োগ করেন, সেই আদালত চত্বরে আইনের অপব্যবহার হচ্ছে। পরের দিন থেকে পুলিশ আদালত চত্বরে যাকে প্রকাশ্যে ধূমপান করতে দেখেছে, তাকেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করেছে। এ কারণে ওই সময় আদালত চত্বরে প্রকাশ্যে ধূমপান করার কেউ সাহস করত না। তবে সে অবস্থা এখন অনেকটা ফিকে হয়ে গেছে। দেশে যে ধূমপানবিরোধী একটা আইন আছে, সেটাই যেন এখন অজানা। এখন প্রকাশ্যে ধূমপান করা যেন এক রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেই কোনো বাছবিচার। এক গবেষণায় দেখা গেছে, আমাদের দেশের ৩০ শতাংশ নারী কর্মস্থলে, ২১ শতাংশ পাবলিক প্লেস বা পরিবহনে পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হয়। আর ধূমপানের কারণে এসব নারীরা ক্যানসার এবং মৃত সন্তানপ্রসবসহ ভয়াবহ রোগের শিকার হতে পারেন। এ অবস্থা বিবেচনা করে পাবলিক প্লেস ও পাবলিক পরিবহন ধূমপানমুক্ত করার জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হচ্ছে। তবে তা পর্যাপ্ত নয়। একই সঙ্গে বিদ্যমান আইনটি সংশোধনে হাত দিয়েছে সরকার। সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদ অনুমোদিত এই খসড়া বিধিমালায় প্রকাশ্যে ধূমপানের শাস্তি ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১০০ টাকা করা হয়েছে। একই সঙ্গে পাবলিক প্লেসের ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকেও শাস্তি দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এখানে পাবলিক প্লেসের সংজ্ঞাও নতুন করে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। নতুন সংজ্ঞায় পাবলিক প্লেস বলতে সম্মিলিতভাবে ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের স্থান বা ভবনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ পাবলিক প্লেসের মধ্যে রয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি অফিস, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, পাঠাগার, হাসপাতাল, ক্লিনিক, বেসরকারি সংস্থার কার্যালয়, আদালত ভবন, বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর, যানবাহন, রেল ভবন, বাস টার্মিনাল, এক্সিবিশন সেন্টার, মার্কেট, থিয়েটার হল, শপিং মল, রেস্তোরাঁ, পাবলিক টয়লেট, জনসভা, যাত্রীছাউনি, বাস স্টপেজ, মেলা প্রাঙ্গণ এবং সরকার ও স্থানীয় সরকার কর্তৃক ঘোষিত পাবলিক প্লেস। নতুন এই আইনে নির্ধারিত কিছু স্থানকে ধূমপান জোন ঘোষণার প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এই আইনের খসড়ায় তামাকজাত পণ্যের বিজ্ঞাপন প্রচার করলে তিন মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং এক লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। তবে এবারও নাটক, চলচ্চিত্রসহ প্রচারমাধ্যমে ধূমপানের দৃশ্য প্রদর্শন বন্ধে আইনের কোনো বিধান বা নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়নি। তাই আইনে শুভঙ্করের ফাঁকি ঠিক থেকেই গেল।
তার পরও ধূমপানকে নিরুৎসাহিত করতে প্রকাশ্যে ধূমপানের জরিমানা বৃদ্ধিসহ যেসব বিধান রাখা হয়েছে তা অবশ্যই যুগোপযোগী। তবে ২০০৫ সালে প্রণীত আইনের মতো নতুন সংশোধিত এই আইনটিরও যদি বাস্তবিক প্রয়োগ না হয়, এটিও চলে যাবে সোজা কাচের ঘরে। যাকে এক কথায় বলা যায় না মানার আইন।
শেয়ার করুনঃ