বাঙালির অনন্য গৌরবময় বিজয়ের মাস ডিসেম্বর। মুক্তিযুদ্ধে জয়ের আনন্দে উদ্বেলিত হওয়ার মাস। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ শেষে ১৯৭১ সালের বাঙালি জাতি স্বাধীনতাসংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করেছিল এ মাসে। হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পেরিয়ে গেছে বিজয়ের ৪১টি বছর। যদি বিজয়ের ৪২ বছরে দাঁড়িয়ে প্রত্যাশা আর প্রাপ্তির হিসাব মেলাতে যাই, তাহলে অনেক কিছুই গরমিল মনে হয়। মনের ভেতর হাজারো প্রশ্ন এসে নিজেকে ক্রুশবিদ্ধ করে। বাংলার দামাল ছেলেরা যেভাবে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল, সেভাবে কি আমরা পারি না দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে? রক্তমাখা ওই লাল-সবুজের পতাকার দিকে একবার তাকিয়ে হলেও আমরা কি শপথ নিতে পারি না সবাই মিলে এগিয়ে নিয়ে যাব এ দেশটাকে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে খুন-হত্যা, জ্বালাও-পোড়াও আর সংঘাতের মধ্য দিয়ে এক অনিশ্চয়তার দিকে ধাবিত হচ্ছে রক্তে কেনা আমাদের সোনার বাংলা।
স্বাধীনতার পর দীর্ঘ চার দশক পরও আমাদের ভাবতে হচ্ছে গণতন্ত্র নিয়ে। রাজনৈতিক অস্থিরতায় হাবুডুবু খাচ্ছি প্রতিনিয়ত। এ সুযোগে বারবার সামরিক শাসনের মতো অশুভ শক্তি ক্ষমতায় আসার সুযোগ পাচ্ছে। দারিদ্র্য ও দুর্নীতি থেকে মুক্তির সংগ্রাম আর প্রবল বন্যা, সিডর, ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়েছে জাতি। অনেক ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত লক্ষ্য পূরণ হয়নি, অনেক ক্ষেত্রে হয়তো অগ্রগতি হয়েছে ধীরগতির। তদুপরি হতোদ্যম হয়নি এ দেশের মানুষ। এরই মধ্যে ঘরে এসেছে নোবেল পুরস্কার। হার না-মানা বাঙালি এগোচ্ছে লাল-সবুজ পতাকা উঁচিয়ে।
বিজয়ের ৪১ বছর পর আমরা আর চাই না মারামারি-হানাহানি, হত্যা ও দুর্নীতি। দেশজুড়ে শুধু শান্তির পতাকা ওড়াতে চাই। এটাই হোক এ বছর বিজয়ের মাসের মূল প্রতিজ্ঞা।
একাত্তরের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে স্বাধীনতার স্পৃহায় জেগে ওঠা বাঙালিকে স্তব্ধ করতে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যায় মেতে ওঠে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ২৫ মার্চ কালরাতে। সেই গণহত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে এ দেশের মানুষের ভাগ্যাকাশে নেমে এসেছিল ঘোর অমানিশা। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ প্রাণের বিনিময়ে অবশেষে ঘনিয়ে আসে বিজয়ের সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নেতৃত্বে আত্মসমর্পণ করে ৯১ হাজার ৫৪৯ জন হানাদার সেনা। বিকেল ৪টা ৩১ মিনিটে মুজিবনগর সরকারের পক্ষে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারের উপস্থিতিতে ভারতীয় মিত্রবাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল জ্যাকবের তৈরি করা আত্মসমর্পণ দলিলে সই করেন পাকিস্তানের পক্ষে লে. জেনারেল নিয়াজি এবং মিত্রবাহিনীর পক্ষে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। আর অবিস্মরণীয় সেই মুহূর্তেই বিশ্ববাসীকে অবাক করে পৃথিবীর মানচিত্রে জন্ম নেয় বাংলাদেশ নামের স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাঙালি জাতি পায় লাল-সবুজের একটি জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত এবং মানচিত্র। রক্তাক্ত পথ ধরে মুক্তিযুদ্ধের এই বিজয় অর্জন ছিল ইতিহাসের অনিবার্য পরিণতি।
বাঙালির এই স্বাধীনতাসংগ্রামের বিজয় অর্জনের ইতিহাস কেবল ১৯৭১ সালেই সীমাবদ্ধ নয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাগের এক বছরের মধ্যেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে পাঞ্জাবি শাসকগোষ্ঠী আঘাত করে আমাদের মাতৃভাষা বাংলার ওপর। শুরু হয়ে যায় শোষণ, বঞ্চনা আর বৈষম্যের করুণ ইতিহাস। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর সেই শোষণ থেকে মুক্তি পেতে বিক্ষুব্ধ বাঙালির জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রথম স্ফুরণ ছিল ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। এই চেতনার ধারাবাহিক সংগ্রামের অংশ হিসেবে শেখ মুজিব উত্থাপিত ১৯৬৬ সালে ৬ দফা তথা স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন, ১৯৬৯-এ গণতন্ত্র ও ন্যায্য অধিকারের জন্য গণ-অভ্যুত্থান এবং ১৯৭০-এ নির্বাচনী বিজয়ের মাধ্যমে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাক্সক্ষার বিস্ফোরণ ঘটে। কিন্তু গণতান্ত্রিক সে বিজয় পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র মানতে পারেনি।
ফলে ১ মার্চের অসহযোগ আন্দোলনের পথ ধরে ঘনিয়ে আসে ৭ মার্চ। ১৯৭১-এর ওই দিন রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ভাষণে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বজ্রকণ্ঠে উচ্চারিত হয় স্বাধীনতার অমোঘ বাণী– ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’।
বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে মূলত সেদিন থেকেই গোটা জাতির মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গণহত্যা শুরুর পর মধ্যরাতে অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন দেশের স্বাধীনতা। ধানমন্ডির বাসভবন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু তার স্বাধীনতার ঘোষণায় শত্রুসেনাদের বিতাড়িত করতে শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে লড়াই চালিয়ে যেতে দেশবাসীকে অনুরোধ ও নির্দেশ দেন। শুরু হয় হানাদারদের কবল থেকে দেশকে মুক্ত করার চূড়ান্ত প্রতিরোধ লড়াই, মুক্তিযুদ্ধ। ৯ মাস ধরে চলা সেই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্বিচার গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ আর লুটতরাজের কলঙ্কিত অধ্যায়ের বিপরীতে রচিত হয়েছিল ইতিহাসের আরেকটি মহান অধ্যায়। সেই অধ্যায়ে ছিল মুক্তিকামী বাঙালির অসম সামরিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধজয়ের বীরত্বগাথা। ১৭ এপ্রিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী সরকার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয় ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে হানাদার বাহিনীর আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে। জন্ম নেয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’।
প্রতিবছরের মতো এ মাসেও বিজয়োল্লাসে ভাসবে দেশ, আনন্দে উদ্বেলিত হবে গোটা জাতি। রাজধানী ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত গ্রাম পর্যন্ত উদ্যাপিত হবে বিজয়ের এ মাসটি। উৎসবের সমারোহে জাতি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, জাতীয় চার নেতাসহ মুক্তিযুদ্ধের সব শহীদকে। সেই সাথে আমরা এগিয়ে যেতে চাই সোনার বাংলা গড়ার প্রত্যয়ে। যে দেশে থাকবে না কোনো বিভেদ, থাকবে না কোনো খুনোখুনি, সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজি। একদিন বিশ্বের বুকে মডেল হিসেবে উপস্থাপিত হবে বাংলাদেশ।
শেয়ার করুনঃ