হুমায়ূন আহমেদ : যে ছিল এক মুগ্ধকর। এটি স্থপতি শাকুর মজিদের বই। হুমায়ূন আহমেদকে যেভাবে দেখেছেন, তার বর্ণনা। আমার ভালো লেগেছে। বইটি পড়া শেষ হতে না হতে হাতে নিই হুমায়ূন আহমেদ স্মারকগ্রন্থ। পড়ি আর আমার একটা ধারণা গলে গলে মন থেকে বেরিয়ে যায়। আমার মনের গভীরে একটা হাহাকার তৈরি হয়। একটা ভাবনাকে আঁকড়ে থেকে আমি দুর্দান্ত কিছু স্মৃতি তৈরি থেকে বঞ্চিত থেকেছি। বঞ্চনার কথা বলার আগে ধারণার কথা বলি। আমি মনে করতাম, লেখকের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক ব্যক্তিগত নয়। ব্যক্তি মানুষটার কাছাকাছি যাওয়ার কোনো মানে নেই। লেখক অনেক দিন বেঁচে থাকুন, এই কামনা করি তার অনেক লেখা পড়ার আগ্রহ থেকে। কিন্তু বই দুটি পড়ে মনে হলো হুমায়ূন আহমেদের কাছাকাছি হলে জ্ঞানের রাজ্যে আরও সাবলীল হতে পারতাম।
হুমায়ূন আহমেদের লেখার সঙ্গে পরিচয় ‘সূর্যের দিন’ বইটি দিয়ে। বইটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক। সেটা পেয়েছিলাম উপস্থিত বক্তৃতায় প্রথম হওয়ার পুরস্কার হিসেবে। তখন আমি পঞ্চম শ্রেণী। পড়ি রায়পুরা প্রাইমারি ট্রেনিং ইনস্টিটিউট-সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয়ে। ট্রেনিং নিতে আসা অল্পবয়সী শিক্ষকেরা ক্লাস শেষ করার আগে আমাকে দাঁড় করিয়ে নানা বিষয় বলার ফরমায়েশ করেন। আমি যা মনে আসে, বলি। তাতে শিক্ষকমহলে আমার জনপ্রিয়তা বাড়ে। শুধু গোল্লাছুট খেলায় ব্যথা পাওয়ার পরিমাণ বেড়ে গেল। বন্ধুদের হাতে শক্তি বাড়ল কি না কে জানে, আমার হয়তো সহ্যক্ষমতা কমেছিল!
ক্লাস সিক্সে আবারও হুমায়ূন আহমেদ। ভাইদের হাত ধরে। বড় ভাই একজন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, অপরজন কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তাদের হাতে নানা বই ঘোরে। সেগুলোই পড়তে শুরু করি। বাছবিচার নেই। বিপত্তি ঘটল ‘অমানুষ’ পড়তে গিয়ে। লেখক হুমায়ূন আহমেদ। বিশ্ববিদ্যালয়-পড়ুয়া সাগর ভাই বললেন, পড়ুক। অসুবিধা কী? কলেজে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়া শাওন ভাই বললেন, যে বই আমি স্কুল পাস করে পড়ছি, সে বই এখনি কেন ওর পড়া লাগবে? আর তা ছাড়া বোঝারও তো একটা বিষয় আছে, তাই না? সিক্সের ছাত্র না-ও বুঝতে পারে। পরে জেনেছি, হুমায়ূনের বই পড়া নিয়ে এমন মধুর পারিবারিক স্মৃতি অনেকেরই আছে। কারও কারও বাড়িতে এক বই কয়েক কপি কিনতে হয়। কার আগে কে পড়বে সে প্রতিযোগিতা বন্ধ করতে।
এইচএসসি পরীক্ষার পর বেশ একটা লম্বা ছুটি হলো। সুযোগ এল হুমায়ূন আহমেদের অনেক বই পড়ার। সংখ্যায় তা সেঞ্চুরি হবেই। বই পাওয়া গেল ঝংকার সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রধান অলিদার ঘরে। তিনি হঠাৎ করেই হুমায়ূন আহমেদকে আবিষ্কার করেন এবং সে পর্যন্ত প্রকাশিত সব বই সংগ্রহ করেন। আমি অলিদার ভক্ত। তার যাবতীয় কর্মকাণ্ড আমাকে যারপরনাই মুগ্ধ করে। সেই মুগ্ধতার শুরু প্রথম দেখা থেকেই। তখন আমি ক্লাস থ্রিতে পড়ি। রেডিওর জন্য নাটক করবেন শহীদ উদ্দিন চৌধুরী অলিদা। তাতে দুজন শিশুশিল্পী লাগবে। কে যেন আমাদের দুজনকে খুঁজে বের করে, তা আমার আজ মনে নেই। আমি গেলাম আর ইকবাল গেল। প্রতিদিন বিকালে যাই। নারকেলগাছের নিচে বসি, মুড়ি-চানাচুর-শিঙাড়া খাই, সংলাপ মুখস্থ করি। উচ্চারণ ভুল হয়। অলিদা ঠিক করে দেন। আমি মুখস্থ করি। তা ক্যাসেটে রেকর্ড করা হয়। কিন্তু মনমতো হয় না অলিদার। এভাবে একসময় একটা নাটক শেষ হয়। তা প্রচার হয় কি না তা আমার জানা হয় না। ইকবাল ঝরে যায়। আমি নিয়মিত যেতে থাকি। আবৃত্তি শিখি। সারেগামা না শিখেই হারমোনিয়ামে তুলে নিই কয়েক লাইন গান-‘মায়াবন বিহারিণী হরিণী’।
এরই মধ্যে বিটিভিতে অলিদার আনাগোনা শুরু হয়। আমি হয়ে উঠি ঝংকার সাংস্কৃতিক সংগঠনের সবচেয়ে ছোট সদস্য। পয়লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসে নানা অনুষ্ঠান হয়। সেসব অনুষ্ঠানে কবিতা আবৃত্তি করি। নানা প্রতিযোগিতায় যোগ দিই। সার্টিফিকেট জমা হয়। বিতর্ক করি, পুরস্কার জমা হয়। পারিবারিক বইয়ের সংগ্রহে আমার একচ্ছত্র অধিকার জন্মে।
স্নেহ পাই অলিদার। এবার জেলাভিত্তিক একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠানে অংশ নেবে ঝংকার। তা প্রচারিত হবে বিটিভিতে। থাকবে একটা নাটিকা। লেখক আলাউদ্দিন আল আজাদ। রিহার্সেল চলছে পুরোদমে। অলিদা গান লিখে সুর দিলেন।
মেঘনার শাখা আঁকাবাঁকা পথে এনেছে সজাগ সাড়া
সূর্য বলয়ে চেতনার ছোঁয়া, সে আমার রায়পুরা।
আমাদের সে কী উত্তেজনা! প্রতিদিন রিহার্সেল। তারপর একদিন জেলা সদর নরসিংদীতে ফাইনাল রিহার্সেল। উপস্থিত হলেন বিটিভির ঊর্ধ্বতন। সব ঠিক হলো। শুধু বাদ পড়লাম আমি। কারণ, নাটিকার মূল চরিত্র যদি হাসি-হাসি মুখ করে থাকে তবে বিপদ। বাদ পড়ল নাটিকা।
অভিনয় ছাড়লাম। অলিদাকে ছাড়া হলো না। একটা করে বই আনি, পড়ি, ফেরত দিই। আমার চরিত্র বদলে যেতে থাকে। এক মাঝদুপুরে হাজির হলাম আমার বন্ধু মফিজের বাড়িতে। তারা অবাক। অবাক হবে জানা কথা। হুমায়ূনের বইতেও এমনি চরিত্র দেখে অনেকেই অবাক হয়। আমারও মানুষকে অবাক করতে ভালো লাগল। কিন্তু এর পরের ঘটনা আমার জন্য অবাক করার। এই দুপুরে আমাকে না খাইয়ে ছাড়বে না মফিজের মা। তার ভাইবোনেরা। এই দুপুরে কারও বাড়িতে কেউ এলে তাকে না খাইয়ে ছাড়া নিয়ম মানে ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। এই সময়ে কেউ হাজির হলে বুঝতে হবে, তার উদ্দেশ্য না খেয়ে যাবে না। আমার লজ্জা লাগল। কিন্তু এমনি হুটহাট কারও বাসায় চলে যাওয়াসহ নানা কাণ্ড করে বেড়াতে লাগলাম।
আমার বন্ধুদের ছোট ভাইবোনদের কাছেও হুমায়ূন আর অপরিচিত নেই। টিভির নাটক আর ছাপা বই–দুইয়ে মিলে তিনি পরিচিত, যেন প্রতিবেশী। তাদের কেউ কেউ বলতে লাগল, ভাইয়্যা তো দেখি পুরা ‘নি’। ভাইয়্যা তো অমুক-তমুক। শুনি, ভালো লাগে। এই তুমুল ভালো লাগায় কেটে যায় দিন। সে বছর কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পারলাম না। হতাশ না হয়ে আবারও গল্পের বই পড়া শুরু করলাম।
পরের বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম আইনে। অলিদার সঙ্গে যোগাযোগ কমতে লাগল। বন্ধে বাড়ি গেলে দেখতাম, তিনি ওষুধ বানানোর কাজে মনোযোগ দিয়েছেন। ওনার ইচ্ছে ছিল বড় কারখানা করার, তা হয়নি। দিন যেতে লাগল। আমি চ্যানেল আইতে যোগ দিলাম। খবর পেলাম, অলিদার একটা হাত অবশ হয়ে গেছে। একদিন দেখা করতে গেলাম। খুব চেষ্টা করছিলেন অবশ হাতটা নাড়ানোর। যেন আমাকে বোঝাতে চান, ওই হাতটা ঠিক আছে। জানালেন, দুইটা উপন্যাস লিখেছেন। হুমায়ূন আহমেদ-প্রভাবিত। কথাও বলছেন হুমায়ূন আহমেদের মতো। বললেন, ওগুলো নাটক হলে খুব খুশি হবেন। আমি টিভিতে কাজ করি। চেষ্টা করে দেখব কি না? থাক, অলিদার গল্প আর নয়। তিনি আর আমাদের মাঝে নেই। তার গল্পও তাই আপাতত বন্ধ থাক। বরং তাঁর প্রিয় লেখক হুমায়ূন আহমেদের কথা বলি।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে আমার দেখা হয় ২০০৪ সালে। বইমেলায়। চ্যানেল আই থেকে মেলার খবর সংগ্রহ করার দায়িত্ব আমার। লাইভ করি, সাক্ষাৎকার নিই। হুমায়ূন আহমেদ অন্যপ্রকাশে বসে থাকেন। তাকে ঘিরে থাকে অটোগ্রাফ-শিকারিরা। মেলার প্রবেশপথে র্যাবের সতর্ক প্রহরা। আর্চওয়ে পার হয়ে মেলায় ঢুকতে হয়। কেমন লাগছে? হুমায়ূন আহমেদ বললেন, বন্দী-বন্দী মনে হচ্ছে।
ছড়াকার ওবায়দুল গনি চন্দন বাংলাভিশনের রিপোর্টিং টিমে যোগ দিলে তার কাছে হুমায়ূন আহমেদের গল্প শুনি। তৎকালীন বার্তা সম্পাদক বায়জীদ মিল্কী একদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে এলেন নুহাশ পল্লী। বাংলাভিশনে প্রচার হলো প্রতিবেদন। আমরা দেখলাম হুমায়ূন আহমেদের গাছের ঈর্ষণীয় সংগ্রহ। বাংলাভিশনের কাজের জন্য নানা সময়ে ফোন করা হলে তা ধরতেন হুমায়ূন আহমেদ।
যাহোক, বিয়ের পর বইমেলায় বউ নিয়ে গেলে ভিড় ঠেলে অন্যপ্রকাশের স্টলে যেতেই হয়। নিজের বই অন্যের হাতে তুলে দিয়ে ঘরে ফিরি হুমায়ূনের বই হাতে নিয়ে। বইয়ের কপিরাইট দিই বউয়ের নামে। তা দেখে এক চৌকস সংবাদ উপস্থাপক বলেন, ভাই, কপিরাইট দেখে ভয় পাচ্ছি। একসময় হুমায়ূনের সব বইয়ের কপিরাইট ছিল গুলতেকিনের নামে। আপনারও কপিরাইট পরিবর্তন হবে না তো? সংবাদ উপস্থাপক বললেন, মায়েরা একসময় নিজের মেয়েদের পড়ে শুনিয়েছে হুমায়ূনের বই। হুমায়ূন ছিলেন মধ্যবিত্তের ঘরের মানুষ। তাই হুমায়ূনের দ্বিতীয় বিয়ে মধ্যবিত্ত মেয়েরা কীভাবে নিয়েছে তা এক প্রশ্ন।
লুবনাও মাঝেমধ্যে বলে, ক্রমাগত লেখেন। হুমায়ূন আহমেদের মতো জনপ্রিয় হন। তারপর সে থামে। কী যেন ভাবে, বলে, এত জনপ্রিয়তার দরকার নাই।
এখন চলেন ঘুরতে যাই।
হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ব্যক্তিজীবনে কোনো সম্পর্ক গড়তে যাইনি, কিন্তু ব্যক্তিগত জীবন থেকে হুমায়ূন আহমেদকে দূরেও রাখা গেল না। লেখক যে মানুষের মনে বাস করেন। তার ব্যক্তিজীবনের একটা ঘটনা আমাদের ব্যক্তিগত জীবনে কেন বারবার উচ্চারিত হয়?
শেয়ার করুনঃ