নায়কদের নায়ক বলা হয় বলিউড বাদশা শাহরুখ খানকে। অভিনয় দক্ষতা, সাবলীল অঙ্গভঙ্গি আর ভালোবাসা দিয়ে ইতোমধ্যেই শাহরুখ জয় করে নিয়েছেন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের হৃদয়। ভালবাসা আর সম্মান করে সম্মোধন করে যাকে বলা হয় ‘কিং খান’। মুম্বাইয়ের জনপ্রিয় এই অভিনেতার বর্ণাঢ্য জীবনের কিছু অংশ তুলে ধরা হয়েছে সময় বিচিত্রার পাঠকদের জন্য।
জন্ম ও কৈশোর
১৯৬৫ সালে দিল্লির পাঠান মুসলিম পরিবারে জন্ম শাহরুখের। মা ম্যাজিস্ট্রেট লতিফ ফাতেমা ও বাবা তাজ মোহাম্মদ খান। দিল্লির সেইন্ট কলম্বাস স্কুলের ছাত্র শাহরুখ ছোট বেলা থেকেই লেখাপড়ার পাশাপাশি বরাবরই মনোযোগী ছিলেন খেলাধুলা ও নাট্যাভিনয়ে। যেখান থেকে তিনি অর্জন করেন সম্মানজনক ‘সোর্ড অব অনার’। হন্সরাজ কলেজ থেকে ‘অর্থনীতি’তে সম্মান ডিগ্রি, জামিয়া মিলিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘গণযোগাযোগ’ নিয়ে মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন শাহরুখ। বাবার মৃত্যুর পর ১৯৯১ সালে নতুনভাবে জীবন শুরু করতে দিল্লি ছেড়ে চলে আসেন মুম্বাইয়ে। বিয়ে করেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু গৌরী খানকে। বিয়ের ছয় বছরের মাথায় জন্ম নেন ছেলে আরিয়ান খান, তার দু’বছর পর খান পরিবারে আসে আরেকটি কন্যাসন্তান।
১৯৮০-এর শেষের দিকে বেশ কিছু টেলিভিশন সিরিয়ালে অভিনয়ের মাধ্যমে শাহরুখ খানের অভিনয় জীবন শুরু। ৮৮ সালে ফৌজি টেলিভিশন সিরিয়ালে কমান্ডো অভিমন্যু রাই চরিত্রের মাধ্যমে নিজেকে প্রথম দর্শকের সামনে তুলে ধরেন। পরের বছরই সার্কাস সিরিয়ালে তিনি কেন্দ্রীয় ভূমিকায় অভিনয় করেন, যেটি ছিল একজন সাধারণ সার্কাস অভিনেতার জীবন নিয়ে রচিত। একই বছর তিনি অরুন্ধতী রায়ের ওহ ডযরপয অহহরব এরাবং রঃ ঞযড়ংব ঙহবং টেলি-চলচ্চিত্রে গৌণ চরিত্রে অভিনয় করেন। ফৌজিতে অভিনয়ের মাধ্যমে এই হার্টথ্রব হেমা মালিনীর চোখে পড়েন, যিনি তাকে সুযোগ দেন প্রথম ছবি ‘দিল আশনা হ্যায়’তে অভিনয়ের। ১৯৮২ সালে ‘দিওয়ানা’ সিনেমার মাধ্যমে তার চলচ্চিত্রের জগতে যাত্রা শুরু। এ ছবিতে শাহরুখের বিপরীতে ছিলেন বিদ্যা ভারতী। ছবিটি ব্যবসা সফল হয় এবং তিনি বলিউডে আসন গড়তে সক্ষম হন। আসলে তার প্রথম ছবি হওয়ার কথা ছিল ‘দিল আশনা হ্যায়’ কিন্তু ‘দিওয়ানা’ প্রথমে মুক্তি পায়। একই বছরে কিং খান আরও কিছু ছবি যেমন চমৎকার, বিতর্কিত আর্টফিল্ম ‘মায়া মেমসাবে’ অভিনয় করেন।
১৯৯৩ সালে ‘বাজিগর’ ও ‘ডর’ সিনেমায় খলচরিত্রে অভিনয় করে বিপুল খ্যাতি পান এই বলিউড ব্লাস্টার। ‘ডর’ ছবিটি খুব সাফল্য লাভ করে এবং তিনি তারকাখ্যাতি পান। বাজিগর ছবির জন্য তার ক্যারিয়ারের প্রথম ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ অভিনেতা পুরস্কার পান। এ ছাড়া বলিউড খান ‘কভি হাঁ কভি না’ ছবিতে একজন ব্যর্থ যুবক ও প্রেমিকের চরিত্রে অভিনয় করেন, যার কারণে সমালোচকদের রায়ে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা নির্বাচিত হন। এমনকি শ্রেষ্ঠ খলনায়কের পুরস্কারও গেছে তার ঝুলিতে।
১৯৯৫ ছিল তার জন্য খুবই সাফল্যের বছর। ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’ বক্স অফিস রেকর্ড ভাঙে এবং এর সব কৃতিত্ব পান শাহরুখ। সিনেমাটি ৫২০ সপ্তাহের বেশি দেখানো হয়। ভারতের সর্বাধিকবার প্রচারিত ছবি হিসেবে যাকে তুলনা করা যায় শোলের সাথে, যা ২৬০ সপ্তাহ চলেছিল। ছবিটি বারো বছর ধরে প্রদর্শিত হচ্ছে এবং ১২ বিলিয়ন রুপির চেয়ে বেশি অর্থ আয় করেছে।
‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে’র পর তিনি বেশ কটি ছবিতে সাফল্য পান, যার অধিকাংশই ছিল প্রেমকাহিনি। যশ চোপড়া এবং করন জোহরের সাথে মিলে তিনি বলিউডে সফলতা পেতে থাকেন। এসব চলচ্চিত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে: পরদেশ, দিল তো পাগল হ্যায় (১৯৯৭), কুছ কুছ হোতা হ্যায় (১৯৯৮), মোহাব্বত (২০০০), কাভি খুশি কাভি গম (২০০১), কাল হো না হো (২০০৩) এবং বীর-জারা (২০০৪)। এছাড়া অন্যান্য পরিচালক যেমন, আজিজ মির্জার ইয়েবস (১৯৯৭), মনসুর খানের জোস (২০০০) এবং সঞ্জয় লীলা বনসালির দেবদাস (২০০২) ব্যবসা সফল হয়। আঞ্জাম (১৯৯৪), দিল সে (১৯৯৮), স্বদেশ (২০০৪) ও পহেলি (২০০৫) ছবির জন্য শাহরুখ খান সমালোচকদের নজরে পড়েন।
২০০৬ সালে করন জোহরের কভি আলবিদা না কেহনা (২০০৬) ছবিটি ভারতে মোটামুটি ব্যবসা করলেও বিদেশে ব্যবসা-সফল হয়। একই বছরে ‘ডন’ ছবিতে অভিনয় করেন যেটিও ব্যবসা-সফল হয়েছিল।
২০০৭ সালে এই বলিউড বাদশার প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ছিল ‘চাক দে ইন্ডিয়া’। বাণিজ্য-সফল এই ছবিতে অভিনয়ের জন্য শাহরুখ সপ্তমবারের জন্য ফিল্মফেয়ার সেরা অভিনেতার পুরস্কার পান। তার অন্য মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ওম শান্তি ওম’ ২০০৭ সালের সবচেয়ে বাণিজ্য-সফল ছবি। ২০০৮ সালে শাহরুখের ‘রব বানা দি জোড়ি’ ছবিটি খুব ভালো ব্যবসা করে। বর্তমানে সারা বিশ্বে বলিউডের জনপ্রিয়তম ব্যক্তিত্বদের মধ্যে শাহরুখ খান অন্যতম। এ ছাড়া মাই নেম ইজ খানসহ সম্প্রতি তার বেশ কয়েকটি সিনেমা দর্শকপ্রিয়তা যেমন পেয়েছে তেমনি পর্দা কাঁপিয়েছে হলগুলো।
শুধু টিভি সিরিয়াল ও সিনেমায় অভিনয় করেই থেমে থাকেননি বলিউড সুপার স্টার শাহরুখ খান। পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবেও দীপ্তি ছড়িয়েছেন তিনি। ১৯৯৯ সালে পরিচালক আজিজ মির্জা ও অভিনেত্রী জুহি চাওলার সাথে চলচ্চিত্র প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন কিং খান। এই প্রতিষ্ঠানের প্রথম দুটি ছবি ‘ফির ভি দিল হ্যায় হিন্দুস্তানি’ এবং ‘অশোকা’ ব্যবসা-সফল হয়নি। তার প্রযোজিত তৃতীয় ছবি ‘চলতে চলতে’ ব্যবসা-সফল হয়, ২০০৪ সালে তিনি আরেকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন ‘রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্ট’ নাম দিয়ে এবং এখান থেকে ‘ম্যায় হুঁ না’ চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা করেন। যা বলিউডে দারুণ ব্যবসা করে। ২০০৫ সালে তিনি কল্পকাহিনি নিয়ে ‘পহেলি’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন যা একাডেমি পুরস্কারের জন্য ভারত থেকে মনোনয়ন পায়, তবে পুরস্কার জিততে পারেনি। ভারতের চলচ্চিত্রজগতে ‘পহেলি’ তেমন সফলতা পায়নি। একই বছর তিনি ‘কাল’ নামে একটি চলচ্চিত্র সহ-প্রযোজনা করেন। এ ছবিতে কিং খান অভিনয় না করলেও একটি গানের দৃশ্যে মালাইকা অরোরা খানের সাথে অভিনয় করেন। ‘কাল’ মোটামুটি সফলতা পায়। ‘রেড চিলিস এন্টারটেইনমেন্ট’ থেকে নির্মিত পরের ছবি ‘ওম শান্তি ওম’ ২০০৭ সালে সবচেয়ে সফল ছবি। এই ছবিতে ৩০ জনের বেশি নামী অভিনেতা একটি গানের দৃশ্যে অভিনয় করেছেন।
জনপ্রিয় ব্রিটিশ গেম শো হু ওয়ান্টস টু বি আ মিলিয়নিয়ার? এর হিন্দি সংস্করণ কৌন বনেগা ক্রোড়পতি-এ তিনি সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেছেন। এ ক্ষেত্রে সাবেক উপস্থাপক অমিতাভ বচ্চনের কাছ থেকে দায়িত্ব নেন, যিনি ২০০০ সাল থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত এটি উপস্থাপনা করে জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। ভারতের টেলিভিশনের ইতিহাসে এটি অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি শাহরুখ খান কেবিসির তৃতীয় মরশুম শুরু করেন। এই মরশুম শেষ হয় ২০০৭ সালের ১৯ এপ্রিলে। ২৫ এপ্রিল ২০০৮ থেকে শাহরুখ আর ইউ স্মার্টার দ্যান আ ফিফথ গ্রেডার? এর হিন্দি সংস্করণ ক্যা আপ পাঁসবি পাঁস সে তেজ হ্যায়? এর সঞ্চালকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
ক্রিকেট প্রেমি শাহরুখ
বলিউড তারকা শাহরুখের ক্রিকেট প্রেম নতুন নয়। ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় আসর আইপিএলের ম্যাচে প্রায় সব সময়ই শীর্ষে থাকে তার দল ‘কোলকাতা নাইট রাইডার্স’। বিশ্বেও বাঘা বাঘা সব খেলোয়াড় দিয়ে দল সাজিয়েছেন শাহরুখ। বলিউডের সবচেয়ে নামকরা এবং দামি তারকা শাহরুখ ক্রিকেটের বড় বড় কোনো আসরই বাদ দেন না স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখা থেকে। তবে এই ক্রিকেট ও তার দল নিয়ে মাঝেমধ্যেই তাকে পড়তে হয় নানা বিপত্তিতে। এবারের আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের বিরুদ্ধে তার দল জিতলেও মুম্বাইর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে পাঁচ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলিউড সুপারস্টার শাহরুখ খানকে। স্টেডিয়ামের কর্মীদের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়ার পর তার বিরুদ্ধে এই ব্যবস্থা নিয়েছে মুম্বাই ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশন।
বলিউডের বিখ্যাত এই তারকা ঢাকায় এসেছিলেন ২০১০ সালের ১০ ডিসেম্বর। শুধু ঢাকা নয়, বৈশাখী টেলিভিশনের লাইভ সম্প্রচারের কারণে ওই দিন আনন্দ মেতেছিল গোটা বাংলাদেশের শাহরুখ-ভক্ত। যাদের সাধ্য জুটেছিল তারা টিকিট কিনে স্টেডিয়ামে গিয়ে সামনাসামনি দেখেছে বলিউড মাস্টার শাহরুখকে। অনেকের কাছে এই শাহরুখ-দর্শন স্বপ্নে পাওয়ার মতো মনে হয়েছে। আর যাদের সাধ্য হয়নি ঢাকা সেনানিবাসের স্টেডিয়ামে গিয়ে দেখার, তারাও একেবারে মিস করেননি কিং খানের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করার। শাহরুখ খান ঢাকায় আসার আগে অনেকের ধারণা ছিল একরকম, কিন্তু তার সাবলীল পারফর্ম আর নিজেকে দর্শকের কাছে নিইয়ে দেওয়ায় সব ধারণায় যেন পাল্টে যায় মুহূর্তেই। অনেক দর্শক কখনো ভাবেননি যে বলিউড রাজা এত কাছে টেনে নেবে তাদের। কড়া নিরাপত্তা-বেষ্টনীর মধ্যেই এই কিং খান পারফর্ম করেছেন স্টেডিয়ামের সাধারণ দর্শককে হৃদয় কোটায় ঢুকে। কখনো তার দল নিয়ে গেয়েছেন জনপ্রিয় সব গান আবার করেছেন অভিনয়। বাংলাদেশ এবং দেশের সংস্কৃতির প্রশংসা করতেও ভুলে যাননি তিনি। এ দেশের মানুষের ভালোবাসায় মুগ্ধ হয়ে নিজেকে মেলে ধরেছেন দর্শকের সামনে। স্টেডিয়ামের দর্শকও তাকে এমন আপন করে পাবে, তা-ও হয়তো ভাবেনি। সব অহংবোধ ভুলে ঢাকায় শাহরুখ খানের এমন পারফর্ম আর আচরণে সমালোচকেরাও খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি ওই দিন। একের পর এক জনপ্রিয় সব গান গেয়ে দর্শক মাতিয়ে যান বলিউড কিং।
খ্যাতির বিড়ম্বনা
শুধু ১০০ কোটি মানুষের দেশ ভারতেই নয়, সারা বিশ্বেই তুমুল জনপ্রিয়তা রয়েছে শাহরুখ খানের। কিন্তু এই খ্যাতিও যে তাকে মাঝেমধ্যে বিড়ম্বনা দেবে, তা হয়তো ভাবেন না কিং খান। যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টের বেরসিক ইমিগ্রেশন এই মেগা স্টারের আগমন নিয়ে এমন একটা ঘটনার জন্ম দেয়, যা নিয়ে জিলাপি পাকানোর সব উপাদান এখন ভারতীয়দের ঘরে ঘরে। মার্কিনদের পক্ষে বলা হয় খান সাহেবকে কোনোভাবেই আটকে রাখা হয়নি, বরং লাগেজ আসতে দেরি হওয়ার ফাঁকে অতিরিক্ত দু-একটা প্রশ্ন করা হচ্ছিল। কিন্তু কিং খান নিজেই বলেন অন্য কথা, পাসপোর্টে নামের শেষে খান শব্দটা থাকায় এন্টি টেরোরিস্ট গ্র“পের হাতে তুলে দেওয়া হয় তাকে। দুর্ভাগ্য এই মেগা খানের, ইমিগ্রেশনের কারোরই হয়তো দেখা হয়নি এই সুপার স্টারের ধুমধাড়াক্কা মার্কা মুভিগুলো। আর তাই তো অটোগ্রাফ এবং পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার বদলে তাকে নিয়ে হাজির করে ইমিগ্রেশন বুথে।
বর্তমানে বলিউডের অন্যতম সফল অভিনেতা শাহরুখ খান। হিন্দি চলচ্চিত্রে অসাধারণ অবদানের জন্য তার ঝুলিতে কী না ওঠেনি। ২০০৫ সালে ভারত সরকার এই হার্টথ্রবকে দিয়েছে পদ্মশ্রী পুরস্কার। শুধু তা-ই নয়, বর্তমানে কিং খান পৃথিবীর সফল চলচ্চিত্র তারকা। তার প্রায় কয়েক কোটি ভক্ত এবং মোট অর্থ-সম্পদের পরিমাণ ২৩০০ কোটি রুপির বেশি। বলিউড বাদশা শাহরুখ খানকে বিশ্বের ৭১তম ক্ষমতাশীল ব্যক্তির খেতাবও দিয়েছে নিউজ উইক।
শেয়ার করুনঃ