বিএনপির সামনে কঠিন সময়। ক্ষমতার স্বাদ পেতে হলে কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে চারবারের দেশ পরিচালনায় সুযোগ পাওয়া এ দলটিকে। গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর বেশ বেকায়দায় পড়ে দেশের অন্যতম রাজনৈতিক এই দলটি। তবে সম্প্রতি হয়ে যাওয়া ৫টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া দল বিএনপি। আগামী নির্বাচনে বিপুল বিজয় হবে এমনটাই মনে করছেন দলের নেতা-কর্মীরা। তবে কিছুতেই যেন শনি পিছু ছাড়ছে না বিএনপির। একটার পর একটা অঘটন দেশের এই বৃহত্তম রাজনৈতিক দলটিকে প্রায় বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। ২০০৭ সালের ছদ্মবেশী সামরিক সরকার দলটিকে অস্তিত্বহীন করে তুলতে সব ধরনের আয়োজন করেছিল। যদিও শেষ পর্যন্ত তারা তেমন কোনো সাফল্য পায়নি। বিএনপি ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে গেছে, কিন্তু ক্ষতচিহ্ন এখনো রয়ে গেছে। ফখরুদ্দীন-মইন উদ্দীনের হাত থেকে রেহাই পেলেও ২০০৯ থেকে দলটি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কোপানলে পড়ে। শাসকগোষ্ঠীর নির্যাতন-নিপীড়নে দলটির নেতা-কর্মীরা বেশ বেকায়দায় পড়ে। সরকারের জুলুম-নির্যাতন-অপশাসনের বিরুদ্ধে কার্যকর কোনো আন্দোলনও গড়ে তুলতে পারেনি দলটি। দেশের প্রধান বিরোধী দলের এই লেজে-গোবরে অবস্থার অন্তর্নিহিত কারণ সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা নানা মন্তব্য করেছেন। পত্রপত্রিকার নিবন্ধ আর টিভি টক শোগুলোতে সেসব অভিমত প্রকাশ-প্রচার হচ্ছে। বিএনপির বর্তমান দৈন্যদশার কারণ খুঁজতে গেলে নিকট অতীত ও বর্তমান সময়ের কিছু ঘটনাবলি অবশ্যই বিবেচনায় আনতে হবে।
২০০৭ সালে প্রেসিডেন্ট ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদ প্রধান সেনাপতি জেনারেল মইন উ আহমেদের চাপে দেশে জরুরি অবস্থা জারি করেন এবং ২২ জানুয়ারি (২০০৭) অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদ নির্বাচন বন্ধ হয়ে যায়। জরুরি সরকারের সময় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন নেমে আসে। প্রায় সব রাজনৈতিক দল সে নির্যাতনের শিকার হলেও বিএনপিই ছিল মূল টার্গেট। যে প্রেক্ষাপটে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল, তাতে বিএনপির প্রধান লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়াই ছিল স্বাভাবিক। সে সময় ‘মাইনাস’ ফর্মুলার মাধ্যমে দেশের দুই প্রধান নেতৃত্বকে রাজনীতি থেকে উৎখাতের চক্রান্ত চলে। ওই চক্রান্ত বাস্তবায়নের জন্য জরুরি সরকার প্রধান রাজনৈতিক দল দুটিকে ব্যবহার করতে শুরু করে। তথাকথিত সংস্কারের জিকির তুলে নেতা-কর্মী ও সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়। দেশের তাবৎ খারাপ কাজের জন্য দায়ী করা হয় দুই নেত্রীকে। তৎকালীন শাসকচক্র জনসাধারণের মধ্যে একটি ধারণার সৃষ্টি করতে চায় তা হলো, দেশের রাজনীতি থেকে দুই নেত্রীকে সরিয়ে দিতে পারলেই বাংলাদেশের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
জরুরি সরকারের ছড়িয়ে দেওয়া সংস্কার ভাইরাস আওয়ামী লীগের চেয়ে বিএনপিকেই বেশি আক্রান্ত করে। আওয়ামী লীগের একটি অংশ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে মাইনাস করে দল দখলের স্বপ্ন দেখলেও প্রকাশ্যে কোনো পদক্ষেপ নিতে সাহস পায়নি। দু-চারজন একটু উঁচুস্বরে কথা বলার চেষ্টা করে সাধারণ কর্মীদের হাতে রাম ধোলাই খেয়ে চুপসে যান।
কিন্তু বিএনপিতে ছিল ভিন্ন দৃশ্য, ভিন্ন পরিস্থিতি। দলের দ্বিতীয় প্রধান ব্যক্তি মহাসচিব আবদুল মান্নান ভূঁইয়া (বর্তমানে মৃত) স্বয়ং ভিলেনরূপে আবির্ভূত হন। চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে মাইনাস করে দলের প্রধান পদ ও সরকারের প্রধানমন্ত্রীর চেয়ার দখলের দুঃস্বপ্নে তিনি মোহগ্রস্তহন। ২০০৭ সালের ২৫ জুন তিনি সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করে বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে সরাসরি ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর সাথে যোগ দেয় দলের উল্লেখযোগ্য একটি অংশ; যাঁদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতা ও এমপির সংখ্যাই ছিল বেশি। মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের কোনো রকম সমর্থন-সহযোগিতা মান্নান ভূঁইয়ারা পাননি।
একই বছরে ৩ সেপ্টেম্বর জরুরি সরকারের দায়ের করা মামলায় গ্রেপ্তার হওয়ার আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আবদুল মান্নান ভূঁইয়া ও আশরাফ হোসেনকে যথাক্রমে মহাসচিব ও যুগ্ম মহাসচিবের পদ থেকে বহিষ্কার করেন এবং দলে তাঁদের প্রাথমিক সদস্য পদ বাতিল করেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য অ্যাডভোকেট খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে নতুন মহাসচিব নিযুক্ত করেন। ২০০৭ ও ২০০৮ সালের সেই ভীতিকর দিনগুলোতে বয়োবৃদ্ধ খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে দলকে সংগঠিত রাখেন। জরুরি সরকারের শত হুমকি-ধামকি তাঁকে তাঁর অবস্থান থেকে টলাতে পারেনি। সে সময় খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রায় সবাই ছিলেন দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মী। অতি স্বল্পসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতাই তখন খোন্দকার দেলোয়ারের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। সাধারণ নেতা-কর্মীদের প্রত্যয়দৃপ্ত ভূমিকার কারণে মইন-ফখরুদ্দীনের সরকার তাদের প্রণীত নীলনকশা পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়। দুই নেত্রীকে মাইনাস করা, দেশকে রাজনীতিশূন্য করার পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। রক্ষা পায় রাজনীতি, বেঁচে যায় গণতন্ত্র, বিপদ কাটে রাজনৈতিক দলগুলোর।
২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে বিএনপি। যদিও বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচনে জরুরি সরকার ও নির্বাচন কমিশনের পক্ষপাতিত্ব ও কারচুপির অভিযোগ উত্থাপন করা হয়। তবে রাজনীতি বিশ্লেষকগণের মতে, জরুরি সরকারের ভূমিকায় পাশাপাশি পরিস্থিতি অনুধাবনে ব্যর্থতা, সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিএনপির পরাজয়কে নিশ্চিত করেছে। বিএনপি নেতৃত্বকে দলের সার্বিক পরিস্থিতি অনুধাবনের সময় দেওয়া হয়নি। দুই বছরের জরুরি ‘সিডর’ যে দলটিকে দুমড়েমুচড়ে দুর্বল করে দিয়ে গেছে, সেটা দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব সঠিকভাবে অনুধাবন করতে পারেননি। ওই সময় দলের মহাসচিবসহ একটি অংশ নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিরুদ্ধে অবস্থান নিলেও তৎকালীন সরকারের মদদপুষ্ট একটি ক্ষুদ্র গ্রুপ নির্বাচন যেতে বেগম জিয়াকে প্রলুব্ধ করে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ওই গ্রুপটি কথিত একটি মাঠজরিপের তথ্য-উপাত্ত বেগম জিয়ার সামনে উপস্থাপন করেছিল। তাতে দেখানো হয়েছিল, কমপক্ষে ১৬৯টি আসনে চারদলীয় জোটের প্রার্থীরা বিজয়ী হবে। দলীয় সূত্র বলেছে, ওই মহলটি বেগম জিয়াকে এটাও বুঝিয়েছে যে, ‘ম্যাডাম, বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন। নির্বাচন বর্জন করা হবে মারাত্মক ভুল।’ এই মন্ত্রণা বেগম খালেদা জিয়াকে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে অংশ নিতে উৎসাহী করে তোলে। মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন ওই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করলে ওই চক্রটি বেগম জিয়াকে বোঝায় যে, ‘খোন্দকার দেলোয়ার চায় না আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী হোন।’ এর পর থেকে ওই চক্রটি মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনের সম্পর্কে বেগম খালেদার কান ভারী করতে থাকে; যা দুজনের মধ্যে অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টি করে। চেয়ারপারসন ও মহাসচিবের মধ্যে সৃষ্ট এ দূরত্বের ফায়দা লুটে স্বার্থান্বেষী মহলটি।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলও মনে করছে যে, বিএনপির আজকের যে সাংগঠনিক দুর্বলতা, তার পেছনে সংস্কারপন্থীদের দলে প্রাধান্য দেওয়া অন্যতম কারণ। সংস্কারপন্থীদের ‘অতিমূল্যায়ন’ আর দুঃসময়ের সৈনিকদের ‘অবমূল্যায়ন’ দলটির মধ্যে এক গভীর ক্ষত সৃষ্টি করেছে। প্রয়োজনীয় পরিচর্যা ও প্রতিষেধকের অভাবে সেই ক্ষত গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে; কারও কারও আশঙ্কা তা দুরারোগ্য ক্যানসারে রূপ নিতে পারে।
বিএনপির ৪র্থ কাউন্সিল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর। কাউন্সিলকে ঘিরে দলটিতে সৃষ্টি হয়েছিল প্রাণচাঞ্চল্য। নতুন সদস্য সংগ্রহ অভিযান, ওয়ার্ড, ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌর, মহানগর ও জেলা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে সাংগঠনিক তৎপরতায় এসেছিল গতি। অবশ্য কতিপয় নেতার কোটারি মনোভাব বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় সৃষ্টি করে দ্বন্দ্ব-কোন্দল। ফলে ৭৫টি জেলা কমিটির মধ্যে ৪৫-৫০টি নতুন কমিটি সহযোগেই কাউন্সিল করা হয়।
কাউন্সিলকে ঘিরে নেতা-কর্মীদের মধ্যে যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়েছিল, নতুন জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণার পর তা হতাশায় পর্যবসিত হয়। নিবেদিতপ্রাণ নেতাদের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কমিটি থেকে বাদ পড়ে। দলের দুঃসময়ে যাঁরা সাহসী সৈনিকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তাঁরা অনেকেই ছিটকে পড়েন দল থেকে। প্রথম ধাক্কাটা আসে কাউন্সিলের দিন। ওই দিন চেয়ারপারসনের সঙ্গে খোন্দকার দেলোয়ার হোসেনকে মহাসচিব নির্বাচিত ঘোষণা করার কথা ছিল। কিন্তু চেয়ারপারসনের ব্যক্তিগত কর্মকর্তা এবং সাবেক আমলাদের একটি গ্রুপ ওই ঘোষণা দিতে দেয়নি। সপ্তাহ খানেক পর যেদিন স্থায়ী কমিটি ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের নাম ঘোষণা করা হয়, সেদিন চেয়ারপারসনের এক ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সাংবাদিকদের বলেন যে, পরবর্তী মহাসচিব নিযুক্ত না হওয়া পর্যন্ত খোন্দকার দেলোয়ারই মহাসচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। এ ঘোষণা দলের ভেতর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। দেলোয়ার-বিরোধী গ্রুপ এতে খুশি হলেও অধিকাংশ নেতা-কর্মী ক্ষুব্ধ হন। ওই ঘোষণাকে ‘চরম অপমান’ হিসেবে ধরে নিয়ে খোন্দকার দেলোয়ার দল থেকে ইস্তফা দিতে চাইলেও শুভানুধ্যায়ীদের অনুরোধে তিনি চরম কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরক্ত থাকেন। পরে জাতীয় নির্বাহী কমিটির নাম ঘোষণার সময় তাঁকেও মহাসচিব ঘোষণা করা হয়। সে সময় এ কথা চাউর হয় যে, লন্ডনে অবস্থানরত দলের নবনির্বাচিত সিনিয়র ভাইস-চেয়ারম্যান তারেক রহমানের প্রবল চাপের মুখেই খোন্দকার দেলোয়ারকে মহাসচিব হিসেবে বহাল রাখা হয়। নইলে দেলোয়ার-বিরোধী গ্রুপটি চেয়ারপারসনকে দিয়ে খোন্দকার দেলোয়ারকে বাদ দেওয়ার কাজটি প্রায় করেই ফেলেছিল।
নতুন কমিটি ঘোষণার পর বিএনপিতে যে ক্ষোভ-হতাশার জš§ নেয়, তা দলটির ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে ঠাঁই পেতে নগদ টাকা-পয়সাসহ নানা ধরনের উপঢৌকন বিনিময়ের অভিযোগ পাওয়া যায়। দীর্ঘদিন দলের জন্য কাজ করেছেন, জরুরি অবস্থার দুঃসময়ে সাহসী ভূমিকা রেখেছেন, কাজের দক্ষতা ও যোগ্যতা আছে এমন ব্যক্তিদের শুধু চেয়ারপারসনকে ঘিরে থাকা চক্রটির রোষানলের কারণে ন্যায্য প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আবার জীবনে বিএনপির রাজনীতি করেননি, এমনকি প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না, দক্ষতা-যোগ্যতার প্রচণ্ড অভাব রয়েছে এমন ব্যক্তিরা জাতীয় নির্বাহী কমিটিতে সম্পাদক পদও পেয়েছেন। এসব প্রাপ্তির পেছনে নগদ ও অন্য ধরনের লেনদেনের অভিযোগ পাওয়া গেছে।
জাতীয় নির্বাহী কমিটি ঘোষণার এক বছর পর অনুষ্ঠিত নির্বাহী কমিটির সভায় চেয়ারপারসন বলেছিলেন যে, যাঁরা পদ পেয়েছেন অথচ কাজ করছেন না, তাঁদের পদ ছেড়ে দিতে হবে। তিনি সে সময় নির্বাহী কমিটিতে রদবদলের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর সে হুঁশিয়ারি কিংবা ইঙ্গিতের বাস্তব কোনো প্রতিফলন এখনো পর্যন্ত দেখা যায়নি।
গত সাড়ে চার বছরে সরকারকে চাপে বা বেকায়দায় ফেলার বেশকিছু ইস্যু বিএনপির হাতে এসেছিল। কিন্তু একটি ইস্যুও সঠিকভাবে কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। নেতাদের ভুল কৌশল এবং কর্মীদের ঝুঁকি না নেওয়ার প্রবণতা এর মূল কারণ বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করছে।
দলটি এখন চেয়ারপারসন-নির্ভর হয়ে পড়েছে। বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো কর্মসূচিই পুরোপুরি সফল হচ্ছে না। যেসব কর্মসূচিতে বেগম খালেদা জিয়া উপস্থিত থাকেন, সেগুলোতে লোকসমাগম হয় প্রচুর। রোড মার্চ, গণমিছিল, মহাসমাবেশে এ দৃশ্য দেখা গেছে। কিন্তু অন্যান্য কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো নয়। নয়া পল্টনে যেসব সমাবেশ দলটির পক্ষ থেকে করা হয়, সেগুলোতে সাকল্যে হাজার দেড় হাজার নেতা-কর্মী উপস্থিত থাকে। ত্যাগী নেতাদের মূল্যায়ন না করায় সৃষ্ট হতাশাই এর প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
এ ছাড়া হরতালের মতো কর্মসূচিতে কেন্দ্রীয় নেতাদের ‘ঘরে বসা’ ভূমিকা ব্যাপকভাবে সমালোচিত। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবসহ কয়েকজন নেতা কতিপয় কর্মীসহ কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অন্তরীণ হয়ে থাকেন। তারপর হরতাল শেষে বলা হয়, পুলিশ আমাদের বেরোতে দেয়নি। এ প্রসঙ্গে রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিদের মন্তব্য হলো, পুলিশের দায়িত্ব পুলিশ পালন করেছে। কিন্তু নেতাদের দায়িত্ব নেতারা কি পালন করেছেন? তাঁদের দায়িত্ব পুলিশি বাধা ভেঙে রাজপথে নেমে আসা। কিন্তু তাঁরা সেটা না করে দিন কাটাচ্ছেন ঘরের ভেতর। এমনও দেখা গেছে সারা দিন কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি যাঁদের, হরতাল শেষে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিবের প্রেস ব্রিফিংয়ে তাঁরা উপস্থিত থেকেছেন। টিভি পর্দায় চেহারা দেখানো এসব নেতা সাধারণ কর্মীদের চোখে সুবিধাবাদী ও আপসকামী বলে চিহ্নিত হলেও দলীয় হাইকমান্ড এঁদের ওপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ তাঁদের।
আগামী দিনগুলোতে বিএনপি কোন পথে যাবে, কী করবে তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সর্বত্র। রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যর্থতা ও জনদুর্ভোগ বৃদ্ধির কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষ অসন্তুষ্ট, বীতশ্রদ্ধ। সরকারের প্রতি জনগণের এই নেতিবাচক মনোভাবকে প্রধান বিরোধী দল কীভাবে কাজে লাগাবে বা লাগাতে পারবে কি না তা নিয়ে বিতর্ক এবং সংশয় রয়েছে। অনেকের মতে, জনগণের সমর্থন এ মুহূর্তে বিএনপির পক্ষে থাকলেও সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং নেতৃত্বের অদূরদর্শিতার কারণে তা সঠিকভাবে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হতে পারে দলটি।
সচেতন মহলে ইতোমধ্যেই একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সরকারের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে আটকে গেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এ নিয়ে লেখালেখিও হচ্ছে। রাজপথের ‘তুমুল আন্দোলন’ থেকে সরে এসে এখন নমনীয় অবস্থান নিয়েছে দলটি। বিএনপিকে গৃহপালিত বিরোধী দলে পরিণত করা হচ্ছে। বলা হয়, সরকারের রাজনৈতিক কৌশলের কাছে ‘ধরা’ খেয়ে সমঝোতার পথে চলতে শুরু করেছে তারা। প্রকাশ্যে রাজনীতির গুণগত পরিবর্তনের কথা বলে ভেতরে ‘মামলায় জর্জরিত’ নেতৃত্বকে রক্ষা করতে সমঝোতার পথে হাঁটছে বিএনপি। তারই অংশ হিসেবে আন্দোলনকে সীমিত রাখছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি।
শেয়ার করুনঃ