নির্বাচনের জন্য রাজনীতি, নাকি রাজনীতির জন্য নির্বাচন? গত দুই দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি তথা গণতন্ত্র আটকে আছে শুধুই নির্বাচনের মধ্যে। নির্বাচনের সময় তো বটেই, দুটি নির্বাচনের মাঝের সময়টাতেও রাজনীতি চলে নির্বাচন নিয়েই। একটি নির্বাচন কতটা ভালো বা মন্দ হয়েছে, তা নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্ক চলে দেড়-দুই বছর ধরে। আবার পরের নির্বাচনটি কীভাবে হবে, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে যায় দেড়-দুই বছর আগ থেকেই। এভাবে একটি সরকারের পাঁচ বছর মেয়াদের বেশির ভাগ সময়জুড়েই চলে নির্বাচনী রাজনীতি। মাঝে অল্প যেটুকু সময় থাকে, তখনো নানা ফন্দি-ফিকির চলে কীভাবে আগামী নির্বাচনের ফলাফলটি নিজেদের পক্ষে আনা যায়। অসত্য, অর্ধসত্য, বিকৃত সত্য এবং কথার মারপ্যাঁচে বিপক্ষ দলকে ঘায়েলের চেষ্টা চলে বছরের পর বছর।
আমাদের রাজনীতিতে জনস্বার্থ, দেশের স্বার্থসহ সমাজের নানা সমস্যা-সংকট নিয়ে অল্পস্বল্প রাজনৈতিক তৎপরতা দেখা গেলেও তার পেছনেও থাকে নিজেকে বড় আর অন্যকে ছোট করার অসুস্থ প্রতিযোগিতা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার উন্নয়নে কাজ করার বেলায়ও এটা ভাবেন, কোন কাজটি কখন ও কীভাবে করলে জনসমর্থন বাড়বে, অর্থাৎ নির্বাচনে ভোট পাওয়া যাবে। মোট কথা, রাজনীতিতে যা কিছুই করা হয় বা বলা হয়, সবকিছুর পেছনেই থাকে ভোটের চিন্তা। একটি দল নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসার পরদিন থেকেই যেন ভাবতে শুরু করে, কী করে পরের নির্বাচনটিতেও জেতা যায়। আর পরাজিত দলটি ভাবতে থাকে, কত দ্রুত ক্ষমতাসীন দলটিকে বিদায় করে নিজেদের ক্ষমতায় যাওয়ার পথ পরিষ্কার করা যায়। এক কথায়, বাংলাদেশের রাজনীতি তথা গণতন্ত্র একেবারেই নির্বাচনসর্বস্ব হয়ে গেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে জনকল্যাণ শুধুই মুখের বুলি। যেটুকু কল্যাণ না করলে ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবে না বা পরের নির্বাচনে গালভরা বুলি আওড়ানো যাবে না, সেটুকুই করতে বাধ্য হচ্ছে বড় রাজনৈতিক দলগুলো। বিগত দুই দশক ধরে বাংলাদেশের রাজনীতি আটকে আছে নির্বাচনী জালে। এর মাশুল দিতে হচ্ছে গোটা দেশকে।
স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক সংকটের কারণও এই নির্বাচনী রাজনীতি। আগামী নির্বাচন কীভাবে, কার অধীনে হবে–এটা নিয়েই রাজনীতি চলছে অনেক দিন ধরে। কীভাবে নির্বাচন হলে নিজেদের বিজয়টা নিশ্চিত হবে–সেটা নিয়েই ব্যস্ত রাজনৈতিক দলগুলো। জনগণ ঠিকমতো ভোট দিতে পারবে কি না, ভালো জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবেন কি না, দেশে গণতান্ত্রিক ধারা বজায় থাকবে কি না, নির্বাচন জনগণের জন্য কী নিয়ে আসবে, নতুন নির্বাচিত সরকারটি জনকল্যাণে কতটা নিয়োজিত থাকবে, নির্বাচনে যত প্রতিশ্রুতি আসবে তার কতটা বাস্তবায়ন করা হবে, রাজনৈতিক সংস্কৃতি কতটা উন্নত হবে, সংসদ কতটা কার্যকর হবে, নির্বাচিত সরকার কতটা জবাবদিহিমূলক হবে, দুর্নীতি-অনিয়ম-অব্যবস্থাপনা কতটা কমে আসবে, মানুষের মৌলিক অধিকার কতটা পূরণ হবে, অর্থনীতি কতটা সবল হবে, সুশাসন ও ন্যায়বিচার কতটা নিশ্চিত হবে, সাধারণ মানুষের জীবনমান কতটা উন্নত হবে–এক কথায়, নতুন সরকারটি কতটা জনগণের সরকার হবে–সেটাই সাধারণ মানুষের কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কেবল একটি সরকারের বদলে আরেকটি সরকারকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য যদি নির্বাচন হয়, তাতে জনগণের কিছুই যায় আসে না।
দেশে বারবার নির্বাচিত সরকার এলেও সার্বিক অবস্থার খুব একটা বদল হয়নি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও জননিরাপত্তা বারবারই হুমকির মুখে পড়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার হয়েছে উপেক্ষিত। ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী ও তাদের সমর্থকদেরই ভাগ্যের উন্নতি হয়েছে। যারাই ক্ষমতায় এসেছেন, আগের সরকারের খারাপ কাজগুলোর ধারাবাহিকতা রেখেছেন, খারাপ কাজের প্রতিযোগিতায় নেমেছেন, জনস্বার্থ বিসর্জন দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। বড় দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে এসব কাজে ঐক্যের কোনো অভাব নেই, যত বিরোধ সবই ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ব্যাপারে।
একদলীয় শাসন, সামরিক শাসন, সামরিক লেবাসে বেসামরিক শাসন এবং স্বৈরাচারী শাসনের পর দেশে গণতন্ত্র ফিরে এলেও সত্যিকার অর্থে গণতান্ত্রিক শাসনের স্বাদ এখনো পায়নি দেশের মানুষ। গণতন্ত্রের নামে গত দুই যুগের বেশি সময় ধরে চলছে নির্বাচনী গণতন্ত্র। পাঁচ বছরে এক দিন গণতান্ত্রিক চর্চার জন্য বছরের পর বছর গোটা দেশকে জিম্মি করে রাখছে রাজনৈতিক দলগুলো। একদিন ম্যান্ডেট নিয়ে তারা যেন পাঁচ বছর যা খুশি তা-ই করার লাইসেন্স পেয়ে যাচ্ছে। নির্বাচন যদি হয় গণতন্ত্রের শুরু, তবে নির্বাচিত সরকার এই শুরুতেই আটকে থাকছে। যে উদ্দেশে নির্বাচন, সেটা নিয়ে তাদের ভাবার যেন সময় নেই।
অনির্বাচিত-নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হলেই যে তা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে, তার নিশ্চয়তা কে দিতে পারে? ১৯৯১ সাল থেকে যে চারটি নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে হয়েছে, তার কোনোটিই মেনে নেয়নি ওই সব নির্বাচনে পরাজিত দলগুলো। প্রত্যেকটি নির্বাচন নিয়েই আছে নানা রকম অভিযোগ। সবশেষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের হাত ধরেই এসেছিল এক-এগারোর সেনাসমর্থিত অসাংবিধানিক সরকার। তাদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচন নিয়েও আছে বিস্তর অভিযোগ। বলা হয়, নির্দলীয় বা অরাজনৈতিক সরকারের অধীনে নির্বাচন মানে রাজনীতিবিদদের প্রতি অনাস্থা। তাহলে কী রাজনীতিবিদেরা নিজেদের প্রতি অনাস্থার অপবাদ নিয়েই রাজনীতি করে যেতে চান? ভালো-মন্দ যা-ই হোক, তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থায় চারটি নির্বাচন হয়ে গেছে। যার দুটিতে আওয়ামী লীগ আর দুটিতে বিএনপি জিতেছে। অর্থাৎ এই ব্যবস্থায় দু’দলের ড্র হয়েছে। সময় এসেছে নির্বাচনী খেলার নতুন নিয়ম চালু করা। কারণ আজ যেভাবে আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচন বিএনপি মানছে না, ঠিক তেমনি আগামী দিনে বিএনপির অধীনে নির্বাচন আওয়ামী লীগও মানবে না–এটা নিঃসন্দেহে বলে দেওয়া দেওয়া যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার-ব্যবস্থা চালু রাখার কথা যারা বলেন, তারা কী চান দুই দলের এই অবস্থান চলতেই থাকুক? ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে বারবারই দেশে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হোক? তারা কি নিশ্চয়তা দিতে পারবেন যে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকট এবারই শেষ হয়ে যাবে? নির্বাচন তথা এক দিনের গণতন্ত্রের জন্য বড় দল দুটি গোটা দেশকে আর কখনো জিম্মি করে রাখবে না?
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে কি বিদায়ী সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য হবে? বর্তমান বাস্তবতায় সেটা মনে করার কোনো কারণ নেই। তবে কীভাবে নির্বাচন হলে তা সুষ্ঠু হবে, দুই দলই মেনে নেবে? এ জন্য দরকার দল দুটির সমঝোতা। সেই সমঝোতার জন্য দরকার আলোচনা, দরকার বোঝাপড়া। যেহেতু বড় দুটি দলের মধ্যেই একের প্রতি অন্যের আস্থা-বিশ্বাসের ঘাটতি রয়েছে, সেহেতু নির্বাচনকালীন সরকারটি হওয়া দরকার দু’দলের অংশগ্রহণে, যাতে ক্ষমতার ভারসাম্য থাকে। এ ছাড়া, প্রশাসন ও নির্বাচন কমিশনকে রাখতে হবে যেকোনো দলের প্রভাবমুক্ত। এমনকি একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারে, যদি সব পক্ষ সেই কমিশনকে সহায়তা করে। একবার নির্বাচিত হয়ে পাঁচ বছর যা খুশি করার সাহস কোনো দলই পাবে না, যদি আড়াই বছর পর অন্তর্বর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা চালু করা হয়।
নির্বাচনী রাজনীতির বেড়াজাল থেকে গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে দরকার জনসচেতনতা। কেবল স্বাধীন গণমাধ্যমই পারে সেই সচেতনতা তৈরি করতে। বাংলাদেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে ঐতিহাসিক এক সম্পর্ক। এ দেশের রাজনীতি ও গণমাধ্যম পথ চলেছে সমান্তরালভাবে, একে অন্যের পরিপূরক হয়ে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশে স্বৈরাচারবিরোধী ও গণতন্ত্রের পক্ষে লড়াই-সংগ্রামের যত ইতিহাস, তার সবকিছুতেই রয়েছে গণমাধ্যমের বিশাল অবদান। নব্বইয়ে গণতন্ত্রের নতুন যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে এ দেশের রাজনীতি তথা গণতন্ত্র যেটুকু এগিয়েছে, তার পেছনে গণমাধ্যমের ভূমিকাই সবচেয়ে বেশি। রাজনীতিবিদেরা এটা স্বীকার না করলেও, এ দেশের সাধারণ মানুষ এই সত্যটা জানে। সাংবাদিকতার ছাত্র-শিক্ষক-গবেষক এবং পেশাদার সাংবাদিকসহ যারাই রাজনীতি ও গণমাধ্যমের দিকে নজর রাখেন, তারা সবাই একমত হবেন যে বাংলাদেশে এত সব সংবাদপত্র, টেলিভিশন, রেডিও এবং অনলাইন পত্রিকা না থাকলে, আমাদের রাজনীতির চেহারাটা অনেক বেশি ভয়াবহ হতো। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলাসহ নানা খাতে যত অনাচার, তা যে অনেকগুণ বেড়ে যেত, সে কথা অনেকেই স্বীকার করবেন। গণমাধ্যম নিয়ে রাজনীতিবিদদের যত সমালোচনা আর ক্ষোভ-ঘৃণাই থাকুক না কেন, গণমাধ্যম সক্রিয় আছে বলেই রাজনীতিতে এখনো বিরোধী দল টিকে থাকতে পারে। বাধ্য হয়েই সহনশীলতা দেখাতে হয় সরকারি দলকে। কম করে হলেও জবাবদিহি হতে হয় ক্ষমতাসীনদের। গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের সুবাদে জনগণ এখন অনেক বেশি সজাগ ও সচেতন হওয়ায় যা খুশি করে যে পার পাওয়া যায় না–এ কথা রাজনীতিবিদদের চেয়ে ভালো আর কে জানেন।
এটা সবাই জানেন, গণমাধ্যমের কাজই হলো সমাজের যত অনিয়ম-অসংগতি এবং অবহেলিত-নির্যাতিত মানুষের দুর্দশা তুলে ধরা, শাসকগোষ্ঠীর শোষণ-নির্যাতনের ওপর তীক্ষ্ণনজর রাখা, মানুষের অধিকার রক্ষা ও ন্যায়বিচার পেতে সহায়তা করা এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রযন্ত্রকে জনকল্যাণে নিয়োজিত রাখতে জনমত তৈরি করা। এসব ভূমিকা কমবেশি সব সময়ই রেখেছে বাংলাদেশের গণমাধ্যম। এই ভূমিকা দিনদিনই জোরদারই হচ্ছে। নানা সীমাবদ্ধতার পরও গণমাধ্যম সক্রিয় আছে বলেই সরকার ও নানা সামাজিক শক্তির অপকর্মের কথা মানুষ জানতে পারছে–যার প্রভাব পড়ছে রাজনীতিতে, জনমতে আর নির্বাচনে। সেই কারণেই গণমাধ্যমের ওপর সব সময়ই নাখোশ থাকেন ক্ষমতাসীনরা, অন্যায়-অপকর্ম ফাঁস হয়ে গেলে গণমাধ্যমকে দোষেন তারা। যদিও বিরোধী দলে থাকলে গণমাধ্যমকেই সবচেয়ে উপকারী বন্ধু বলে মানে সব রাজনৈতিক দলই।
বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোতে বিরোধী দলের জয় আর শাসকদলের পরাজয়ের অন্যতম কারণ গণমাধ্যমের শক্তিশালী ভূমিকা। তবে সাধারণ নির্বাচনে সারা দেশে একযোগে এমন ভূমিকা রাখার সুযোগ গণমাধ্যমের আছে কি না–সেই প্রশ্নও আসতে পারে। গণমাধ্যম তখন কতটা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে, সেই আশঙ্কাও আছে। জাতীয় সংসদের নির্বাচন সারা দেশে একই দিনে না করে কয়েক দিনে ভাগ করে করলে গণমাধ্যম ছাড়াও নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করতে পারবে। আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্য দরকার তাদের ঐক্য, দরকার-দলীয় সংকীর্ণতা থেকে বেরিয়ে এসে গণতন্ত্র তথা গণমানুষের স্বার্থে কাজ করা। তাহলেই গণমাধ্যম তার ঐতিহাসিক ভূমিকাটি ধরে রাখতে পারবে।
শেয়ার করুনঃ