বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষাক্ষেত্রের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ, যেখানে জ্ঞান বিকাশের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মানুষ চরিত্র গঠন, জীবনের প্রয়োজনীয় বাস্তবতা, সংগ্রাম ও সমস্যা মোকাবিলায় দৃঢ়চেতা, ধীর, কৌশলী, নিয়মতান্ত্রিকতা, মানবতা ও শৃঙ্খলাবোধসম্পন্ন হওয়ার এক অনন্য এবং বিস্তৃত ক্ষেত্র তৈরি করতে পারে। জীবনে চলতে গেলে বাধাবিপত্তি অনেক কিছুই আসবে, তবে সেগুলো মোকাবিলার কৌশলও এখানেই শিক্ষা নেওয়া হয়। আজ যারা ছাত্র, আগামী দিন কান্ডারি। জাতির নেতৃত্ব তাদের হাতে চলে যাবে। তাই যত বেশি নিজেকে বিকশিত করার সুযোগ থাকে, তত বেশি দক্ষ হওয়া যায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। তবে আমাদের দেশে দিন দিন উচ্চশিক্ষা বা দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্র ছোট হয়ে আসছে। আমাদের অবস্থা দিন দিন ব্রয়লার মুরগির মতো হয়ে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম পুরো সমাজব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশে অবারিত সুযোগ থাকার পরও সম্ভাবনার অকালমৃত্যু ঘটছে প্রতিদিন। ফলে উচ্চশিক্ষার ভবিষ্যৎ অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে দিনের পর দিন।
দেশে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা কত, অধিকাংশ মানুষের পক্ষে বলা বেশ কঠিন। দেশের খ্যাতনামা কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকিগুলো বেশ অজানাই। কারণগুলো খুবই হতাশাব্যঞ্জক। প্রথমত, দেশের কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়কেই কেবল সরকারিভাবে বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাকিগুলো অবহেলায় থেকে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, পুরোনো খ্যাতনামা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের ঐতিহ্য হারিয়ে এখন শিক্ষার মানের জন্য যত না পরিচিত, তার চেয়ে বেশি জাতীয় রাজনীতির নোংরা হস্তক্ষেপ, শিক্ষকদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির গ্যাঁড়াকলে নিষ্পেষিত শিক্ষাজীবনের ফলে হাহাকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যৎ; তৃতীয়ত, মুষ্টিমেয় ছাত্রছাত্রী শিক্ষাজীবনকে চাঁদাবাজি, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড, টেন্ডারবাজি, নিয়োগবাণিজ্য, ভর্তিবাণিজ্য ও প্রেমগঠিত তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ক্যাম্পাসকে রক্তাক্ত করছে বলে এবং সাধারণ ছাত্রদের ঔপনিবেশিক কায়দায় কোণঠাসা করে ফেলায়। চতুর্থত, ক্লাস বর্জন ও বই পড়া বাদ দিয়ে নোট, ফটোকপিভিত্তিক পড়াশোনা, শিক্ষকের সঙ্গে সুসম্পর্ক ও রাজনৈতিক প্রভাবে পরীক্ষায় ভালো করার প্রবণতা। পঞ্চমত, অদক্ষ ও অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ করে সর্বগ্রাসী শিক্ষকশ্রেণী তৈরি করার কারণে আজ পুরোনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা নাজুক।
অন্যদিকে নতুন স্থাপিত দেশের বিভিন্ন জেলা শহরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দক্ষ শিক্ষক, পর্যাপ্ত অবকাঠামোগত সুবিধার অপ্রতুলতা এবং মুক্ত জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র না থাকায় সবার আড়ালেই থেকে যাচ্ছে সেসব বিশ্ববিদ্যালয়। সেগুলো কখনোই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি বা পারবে কি না কখনো সন্দেহ রয়েছে সবার মনে। বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষককে চেনাজানা আছে, তাদের কেউ কেউ মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতাই রাখেন না, তারা এখন দাপুটে শিক্ষক রাজনৈতিক বলয়ের কারণে। আর এ সমস্ত শিক্ষকের কারণে জাতি মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ছে। তা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্যোগে গবেষণার কোনো ব্যবস্থা এখন আর হয় না বললেই চলে। শিক্ষকদের মাঝে ছাত্রছাত্রীদের উৎসাহ দেওয়ার কোনো ইচ্ছা নেই। যতটুকু হয় ব্যক্তিগত উদ্যোগে।
নতুন আটটিসহ দেশে এখন আটান্নটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে। এর কোনোটিই এখনো পূর্ণাঙ্গ রূপ লাভ করতে পারেনি। দেখতে দেখতে কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের বয়স প্রায় বিশ বছর হয়ে গেছে, অথচ মালিকানা নিয়ে দ্বন্দ্ব নিরসন করে কোনো স্থায়ী ক্যাম্পাস, স্থায়ী ও মানের শিক্ষক তৈরি করতে পারেনি সেসব বিশ্ববিদ্যালয়। আবার অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় যখন-তখন নিজেদের মতো করে নিয়ম তৈরি করে ছাত্রদের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নেই কোনো নির্দিষ্ট নীতিমালা। যে যখন যেভাবে ইচ্ছা ভর্তি হতে পারে। আর একবার ভর্তি হওয়ার মানেই হচ্ছে মহাজনের কাছে নিজের জমি বন্ধক দেওয়া। মহাজন যেমন সাদা কাগজে স্বাক্ষর রেখে বা আঙুলের ছাপ রেখে নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করত বা করে, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষও তেমন আচরণ করে ছাত্রছাত্রীদের সাথে। দু-চারটি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া বাকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পাঁচ থেকে দশ শতাংশের বেশি দক্ষ শিক্ষক নেই। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত কোনো কলেজের শিক্ষক দিয়ে ক্লাস পরিচালনা করে থাকে, যা পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে কলুষিত করছে। আবার শিক্ষকদের গবেষণা করার সুযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে একেবার আশাতীত। ছাত্রছাত্রীরা ক্যাম্পাসে অনেকটা প্রাইভেট কোচিংয়ের মতো ক্লাস করে বেরিয়ে পড়তে হয়, কারণ ক্লাস শেষে বসার কোনো ব্যবস্থা নেই, নেই কোনো ক্যানটিন, খেলার ব্যবস্থা। যা কিছু আছে, সবই মনকাড়া বিজ্ঞাপনে ও আশ্বাসে। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরি ধনী পরিবারের শোপিচের মতো। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আছে কেবল চটকদার বিজ্ঞাপন। আর আছে ‘ইয়েস, নো এবং ভেরি গুড’ বলার মতো কিছু ইংরেজি, যা তোতা পাখির মতো বলে যায় প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে।
ওপেন ক্রেডিটের নামে যা অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয় করছে, এক কথায় জালিয়াতি, কারণ ছাত্রদের কোর্স নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো স্বাধীনতা তো নেই-ই, বরং সব সময় তিন-চার ব্যাচকে একত্র করে কোর্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করে দেয়। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। ফলাফলের ক্ষেত্রে অনেক সময় অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী প্রথম শ্রেণী বা জিপিএ ৩.৫-এর বেশি পেয়ে থাকে, যারা ইংরেজিতে একটি সঠিক বাক্যও লিখতে পারে না। চার বছরের কোর্স শেষ করার পর অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী পুরো সিলেবাস বলতে পারে না, কারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে লিখিত কোনো সিলেবাস নেই, যিনি যখন ক্লাসে যান, তখনই তার মতো করে পড়ান। সবচেয়ে বড় যে ক্ষেত্রটি ছাত্রছাত্রীরা অনুভব করে ভর্তির ক্ষেত্রে, ক্লাস করার ক্ষেত্রে, পরীক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে, বৃত্তিপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে, কোর্স নেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো লিখিত বা অলিখিত স্পষ্ট নিয়মনীতি নেই। যখন প্রয়োজন এবং স্বার্থকে যেভাবে কাজে লাগানো যায়, তখনই সেভাবে বলে থাকে। এতে ছাত্রছাত্রীরা বঞ্চিত হয় অধিকাংশ সময়। কোনটি আসল বা কোনটি নকল ক্যাম্পাস বোঝার কোনো উপায় নেই। কারও কারও একের অধিক ক্যাম্পাস আছে, যেখানে এক রুম বা দুরুমেই সবই হয়। গার্মেন্টস, ব্যাংক, আবাসিক, রেস্তোরাঁ, হোটেল বা দোকানের ওপর ক্যাম্পাস হওয়ায় সেগুলোর অবস্থা বাণিজ্যিক কোচিংয়ের চেয়েও ভয়ানক।
এত কিছুর পরও কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে আশার আলো আছে কিছু সফলতার কারণে। আর এই সফলতা ক্ষেত্রবিশেষে প্রতিষ্ঠিত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও ভালো। প্রথমত, জীবনের অনিশ্চয়তা ও শিক্ষাজীবনের সমাপ্তির নিশ্চয়তা না থাকায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবর্তে কিছু মেধাবী বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে বেছে নিচ্ছে। ফলে নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে ভালো ফলাফল ও নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য উপযুক্ত করে তুলছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিজেদের কৃতিত্ব নেওয়ায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। দ্বিতীয়ত, কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু তরুণ শিক্ষক আছেন যারা শিক্ষকতাকে ব্রত হিসেবে নেওয়ায় ছাত্রছাত্রীরা বেশ ভালো করছে। ওই সমস্ত শিক্ষক শিক্ষার মানকে প্রশংসনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছে।
এই সমস্যা বা অসংগতির জন্য কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হয়, তবে তা ভুল বা অন্যায় হবে। কারণ, অনেক সময় সময় সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যায় না; আবার অনেক সময় মঞ্জুরি কমিশনের উদাসীনতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সুযোগ পেয়ে থাকে। মঞ্জুরি কমিশনের সদস্যরা নিজেদের বিলাসী জীবনে ও যে রাজনৈতিক প্রভাবে কমিশনের সদস্য হন, তাদের সেবায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন। অন্য দিকে শিক্ষা মন্ত্রণালয়েরও তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ ও পরিচালনার কৌশল স্বচ্ছ করার দায়িত্ব তাদের। রাষ্ট্রপ্রধান কয়েক দিন পর পর কনভোকেশনে বক্তব্য প্রধানের মাধ্যমে নিজের দায়িত্ব শেষ করলেই চলবে না। মহামান্য হাইকোর্টও কোনো মামলা বা অনিষ্পত্তিকৃত বিষয় দীর্ঘদিন ধরে অনিষ্পত্তি অবস্থায় রেখে দিলে এই সমস্যার সমাপ্তি কখনোই হবে না। সবশেষে এ কথা বলা চলে, সবার সদিচ্ছা, সমন্বয় ও সততা এবং দেশপ্রেমের মাধ্যমেই কেবল এগুলোকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপদান সম্ভব।
সেক্রেটারি, চারুতা ফাউন্ডেশন
শেয়ার করুনঃ