চলছে শরৎকাল। শরতের মূল আকর্ষণ নানা বৈচিত্র্যের কাশফুল। নদীতীরে, বনের প্রান্তে কাশফুলের দৃষ্টিনন্দন রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি, এমন মানুষ খুঁজে মেলা ভার। গাছে গাছে শিউলির মনভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন নীল আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। শরৎকালে কখনো কখনো বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দবারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। প্রকৃতির এ অপরূপ যেন প্রিয় মানুষের সান্নিধ্য চায়। হয়তো ইচ্ছা হয় গোধূলির ওপারে হারিয়ে যেতে প্রিয়জনের হাতটি ধরে। তাই প্রকৃতির কবি জীবনানন্দ দাশ এ ঋতুর চরিত্রের সাথে বর্ণনা করেছেন প্রিয়তমাকে। তিনি তার ‘এখানে আকাশ নীল’ কবিতায় লিখেছিলেন, ‘এখানে আকাশ নীল–নীলাভ আকাশজুড়ে সজিনার ফুল/ ফুটে থাকে হিম শাদা–রং তার আশ্বিনের আলোর মতন’।
ঋতু পরিক্রমার তৃতীয় ঋতু শরৎ। বাংলা ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎকাল। ইংরেজি মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎ ঋতুর পথচলা। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক। সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলো-ছায়ার খেলা দিনভর–এসব মিলেই তো শরৎ। শরৎকালের দ্বিতীয় মাস, অর্থাৎ আশ্বিনের শুরুর দিকেই শরতের আবির্ভাবটা বেশি লক্ষণীয়। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ। জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোর ধারায় শ্রাবণঢলের পর আসে শরতের আলো-ছায়ার খেলা; এই মেঘ, এই বৃষ্টি, আবার এই রোদ।
শরৎকালে নাকি মনটা নেচে ওঠে ছুটির নেশা, উৎসবের নেশায়! কারণ, এ শরৎকালে মাঠে মাঠে সবুজ ধানের ওপর সোনালি আলোর ঝলমলানি দেখা যায়। প্রতীক্ষায় থাকে কৃষকেরা আসন্ন নবান্নের। আলোক-শিশিরে-কুসুমে-ধান্যে বাংলার প্রকৃতিও খুশি। আর বাঙালির সেই প্রাণের উৎসবটা তো রয়েছেই–শারদীয় দুর্গাপূজা। শরৎ শারদীয় আরাধনায় হিন্দুসমাজকে উৎসবমুখর করে, বিজয়ার বেদনায় করে ব্যথিত।
শরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/ শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/ বনের-পথে-লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/ আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি’। শুধু রবীন্দ্রনাথই নন, শরৎ নিয়ে কাব্য রচনা করেছেন, জনপ্রিয় বাংলা গানও রয়েছে শরৎবন্দনার। উৎপল সেন লিখেছিলেন, ‘আজি শরতের আকাশে মেঘে মেঘে স্বপ্ন ভাসে’।
শরতের শুভ্রতার কাছে হেরে গেছেন বাংলার প্রত্যেক কবি। শুভ্রতার ঋতু শরতের বর্ণনা দিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আজি কি তোমার মধুর, মুরতি/ হেরিনু শরৎ প্রভাতে। হে মাতা বঙ্গ-শ্যামল অঙ্গ ঝরিছে অনল শোভাতে’-ঝকঝকে কাচের মতো স্বচ্ছ নীল আকাশ আর তার মধ্যে পেঁজা তুলার মতো সাদা মেঘমালা–এসব নিয়েই প্রকৃতি বরণ করে নেয় শরৎকালকে। কিন্তু, শরতের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অপরূপ বর্ণনা আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে শরৎকালের সেই মাধুর্য এখন তেমন একটা খুঁজে পায় না মানুষ। তবু বছর ঘুরে ষড়ঋতুর বৈচিত্র্য ছড়াতে আসে শরৎকাল।
রবীন্দ্রনাথ ঠিক অমনি রূপ দেখেই গেয়ে উঠেছেন : ‘অমল ধবল পালে লেগেছে/ মন্দ-মধুর হাওয়া, দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।’ কিন্তু রবীন্দ্রনাথ হয়তো শরতে এতটাই পরিতৃপ্তি বোধ করেছিলেন যে শারদ রাতের প্রভাতে তিনি তাঁর জীবনকাল শেষ হলেও হয়তো দুঃখবোধ করতেন না। উত্তরমুখী তেমন কারও হাতে তাঁর বাঁশির সুর আর মোহন বাঁশিটি অমন করে দিয়ে যেতে চেয়েছিলেন তিনি। তাই তো গেয়েছেন : আমার রাত পোহালো শারদ-বুকে/ বাঁশি-বাঁশি, তোমার দিয়ে যাবো/ কাহার হাতে।’
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গেয়েছেন : ‘শিউলী ফুলের মালা দোলে/ শারদ রাতের বুকে ঐ’। শরতের প্রথম প্রভাতে আজ সেই শিউলিফুল ফুটবে, তার বিকশিত রূপ আর গন্ধ ছড়াবে বাতাসে। আমোদিত হবে প্রকৃতি আর সেই সাথে প্রফুল্ল এবং উৎফুল্লচিত্ত হয়ে উঠবে মানুষ এবং এই রসহীন নগরজীবনে যারা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে, তারাও সচকিত হবে শরতের সুরভিমাখা নিমন্ত্রণে। সেই কবে যারা পল্লির স্নেহসান্নিধ্য ছেড়ে জীবিকার তাগিদে ইট-পাথরের বিরস কঠিন-কঠোর নগরযাপন শুরু করেছে, তারাও আজ উপলব্ধি করবে : সত্যিই তো শরৎ এসেছে, আকাশে-বাতাসে তারই সৌরভ, প্রীতিগন্ধময় আবেশ ছড়ানো দিন আজ।
শরতের মনভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায়, তা বোঝা বড়ই মুশকিল! রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় মনেও যেন জমে মেঘ, আবার কখনো হয়ে ওঠে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। কিন্তু ব্যস্ত এ নগরে, শত ব্যস্ততার মাঝে আমরা পারি না মনের আকাক্সক্ষায় শরতের রঙে সাজাতে। তবু যেন মনে হয় হারিয়ে যাই–শরতের কাশফুল, গোধূলি, শিউলি আর জ্যোৎস্নার মাঝে। প্রিয়জনের হাত ধরে অনুভব করি স্নিগ্ধতা।
শেয়ার করুনঃ