একটি বিশেষ ঘোষণা! একটি বিশেষ ঘোষণা! লালরঙা এলাকা থেকে একটি ছয় বছরের মেয়ে হারিয়ে গেছে। একটি ছয় বছরের মেয়ে হারিয়ে গেছে। মেয়েটির পরনে ছিল…
ঘোষণার বাকিটুকু শোনা গেল না। সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঘোষণার মাইক নিয়ে এত দ্রুত এলাকা ত্যাগ করল যে বাকি কথাটুকু মিলিয়ে গেল বাতাসে। তাতে বিরক্ত রহম আলী। পান-সিগারেট-বিস্কুটের টঙদোকান তার। বিরক্তি চেপে রাখা স্বভাবে নেই, তাই বলল, কী যে দিন আইছে, এখন খালি ভটভটি। আগে কত ভালা আছিল। রিকশার সঙ্গে মাইক বান্ধা থাকত। আস্তে-ধীরে চলত, লোকজন ঠিকমতো ঘোষণা জানত, সব ফেরত পাইত।
বেনসন একটা…
কথা থামে রহম আলীর। অন্য কেউ চেষ্টা করলে থামত না সে। এমনকি থানার সেকেন্ড দারোগা সাবের সামনেও সে থামে না। কিন্তু থামাতে চাইছে কাস্টমার। কাস্টমার হলো লক্ষী। পেটের ভাত। কাজেই তাকে থামতে হয়।
আর কিছু? সরু চোখে ক্রেতা যুবকের দিকে তাকায় রহম আলী। গাঁজার অভ্যাস থাকলে এই প্রশ্নের পর আর ক্রেতাকে থামানো যাবে না। এই গোপন ব্যবসায় তার অনেক গোপন ইশারা-ইঙ্গিত লাগে। যেই ব্যবসার যেই নিয়ম আরকি। প্রকাশ্য ব্যবসার প্রকাশ্য নিয়ম, গোপন ব্যবসার গোপন নিয়ম। মুচকি হাসে সে।
থানায় ঢোকার রাস্তা কোনটা?
মামলা করবেন স্যার?
না, জিডি করব।
জিডি? বাসায় চুরি হইছে? চুরি হইলে মামলা করাই ভালা। পুলিশ যাবে। বাড়ির আশপাশে দুই-চারটা চক্কর দেবে। তাতে আপনার সম্মানও বাড়বে, ভবিষ্যতে চুরির সম্ভাবনা কইমা যাবে।
আপনি একটু বেশি কথা বলেন, মুখ খুলে যুবক। সার্টিফিকেট হারিয়েছে। নতুন সার্টিফিকেট তুলতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপন নিয়ে এসেছি, এখন দরকার জিডি করা।
সার্টিফিকেট হারাইলে সমস্যা নাই। হাসি বাড়ে রহম আলীর, বলে, লেখাপড়া না হারাইলেই হইছে। যান সাব, ওই যে নারিকেলগাছের পাশের গেইট। ওইটাই থানার পথ। যান।
সিগারেট পকেটে ঢুকিয়ে থানার দিকে যেতে শুরু করে যুবক। হন হন করে হাঁটছে সে। চলনে তাড়াহুড়ো ভাব। যেন থানায় গেলেই পাওয়া যাবে সার্টিফিকেট।
কিরে তোর কী? দোকানের সামনে বাঁশের বেঞ্চে বসে থাকা লাল চোখের আরেক যুবকের দিকে তাকায় রহম আলী।
একটা টান দিতে মন চায়।
এই সকালে? গতকাইলকারটার টাকা তো পাই নাই।
থানার পাশেই যে গাঞ্জা বেচো ডর করে না তুমার? প্রশ্ন ছুড়ে দেয় লাল চোখের যুবক। এই প্রশ্নের জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিল না রহম আলী। কিছুটা থতমত খায় সে। তাকিয়ে থাকে যুবকের দিকে। কত হবে তার বয়স? পঁয়ত্রিশ নাকি চল্লিশ। বোঝা যায় না। কমও হতে পারে। উষ্কখুষ্ক চুল। যত্ননেই শরীরের কোথাও। যত্নপাবে কোথায়? সংসার থাকলে না হয় যত্ন। অপরাধীর কি সংসার হয় সেভাবে?
তুই যে জামিনি হইয়াও থানার সামনে গাঞ্জা খাস, ভয় লাগে না তোর?
আমি তো চুরি কইরা খাই। জামিনে আছি আবার ঢুইকা যামু। ডর নাই। আর আমি তো পুলিশের ফর্মা।
হ, তুই হইছস সরিষার মইধ্যে ভূত। যা ভাগ। সাতসকালে বাকি নাই।
বাকি নাই ক্যান? একটু আগে না বেনসন বেচলা। আর জানো তো আমি কিন্তু ফর্মা। চাইলে দারোগা সাবরে কইয়া দিতে পারি তুমি গাঞ্জা বেচো। তুমার কিন্তু হালুয়া টাইট হইতে সময় লাগব না।
চিড়বিড় করে মাথায় রাগ উঠতে থাকলে এক গ্লাস পানি পান করে রহম আলী। একবার ভাবে, সব বলে দেয়। লাল চোখের যুবক পুলিশের ইনফর্মার হলে সে কি কম নাকি? সে তো পুরো ফাঁদ পেতে বসে আছে। এই এক দোকানের আড়ালে আস্তে আস্তে এই এলাকায় মাদক ব্যবসার পুরো তথ্যই তো জেনে যাবে সে। আর সে জানা মানে থানার সেকেন্ড দারোগার জানা। জাল ফেলা হইছে মাত্র সপ্তাহ দুয়েক হইল। এলাকার মূল ক্রিমিনাল ধরতে পুলিশকে রহম আলীর এই যে সহযোগিতা, তা কি বলে দেওয়া ঠিক হবে এখন? না। নিজেকে সংযত করে সে। লাল চোখের যুবক পুলিশের না হয়ে মাদক চোরাচালানিদের ইনফর্মারও হতে পারে।
ধর। আইজ দিলাম। কাইল কিন্তু আর পাবি না।
খুব যতেœ পুঁটলিটা পকেটে রাখে যুবক। দাঁড়িয়ে থাকে দোকানের সামনে। তার গায়ে ধুলো ছড়িয়ে থানার প্রবেশ করে ওসি সাবের জিপ গাড়িটি। রহম আলী দেখে তাতে বসে আছে এক তরুণী। কত হবে বয়স? পঁচিশ হতে পারে, সাতাশও হতে পারে। তবে তার চেয়ে বেশি নয় কোনোভাবে। উদ্ভ্রান্ত চোখ তার। কী মামলা? ঠিক অনুমান করতে পারে না রহম আলী। একবার ভাবে, ডাকাতি। আবার ভাবে, না, তাহলে সেই মহিলাকে ধরে আনার কথা না। ঢক ঢক করে আরেক গ্লাস পানি পান করে রহম আলী। দিনের শুরুতেই বেশ গরম পড়ছে।
দুই .
একটু বসেন, মুনশি আসুক।
কনস্টেবলের আন্তরিকতা ভালো লাগল যুবকের। তাশরিফ আলম তার নাম। থাকে মেসে। আর তাতেই নিরাপদে রাখা যায়নি তার সার্টিফিকেট। পেপার ও পুরাতন বইয়ের সঙ্গে বিক্রি হয়ে গেছে তার পরীক্ষা পাসের সনদও।
আপনি কি মনে করেন মেসের লোকজন তা ইচ্ছে করে বিক্রি করে দিয়েছে? জানতে চায় মুনশি, পুলিশ হলেও তার কাজ দাপ্তরিক। এটা সেটা লেখা। ফলে অপরাধের নানা মাত্রা সম্পর্কে ভালোই জ্ঞান রাখে লোকটি। তার প্রশ্ন গেঁথে যায় তাশরিফের বুকে। সত্যিই কি পুরোনো বই ও পেপারের সঙ্গে ভুলে চলে গেছে তার সার্টিফিকেট নাকি ইচ্ছে করেই। কে করতে পারে? সুমন? জাহিদ? কিন্তু কেন?
না, তা মনে হয় না।
তাহলে চুরি হয় নাই?
এক রকম চুরি তো বটেই। তাকে জিজ্ঞাসা না করেই তো বিক্রি করা হয়েছে পেপার। অনুমতি না নেওয়া যদি চুরি হয় সেটা তো চুরিই। আবার পেপার বেচার টাকার ভাগও সে পেয়েছে আনুপাতিক হারে। তাহলে তাকে চুরি বলা যায় কি?
না, লেখেন হারিয়ে গেছে।
আবেদনপত্র লিখে নিয়ে এসেছেন?
জি।
আবেদনপত্রটি মুনশির সামনে ধরে রাখে তাশরিফ। সেদিকে লক্ষ নেই মুনশির। সে তাকিয়ে আছে প্রবেশপথে দিকে। সেখানে পুলিশের গাড়ি থেকে নামানো হচ্ছে এক তরুণীকে। তার দুহাত ধরে রেখেছে দুই নারী পুলিশ। মহিলার চুল পরিপাটি। চেহারাতেও অস্বাভাবিকতা নেই তেমন, তবে চোখ উদ্ভ্রান্ত। বেশ সাবলীলভাবেই হেঁটে পার হলো ঘর ও গাড়ির মাঝের পথটুকু।
এই যে আবেদনপত্র।
রাখেন আবেদনপত্র, একটু বসেন ভাই, আগে পাষণ্ড দেখে নেই।
পাষণ্ড মানে?
যে মা নিজের মেয়েকে খুন করতে পারে, তাকে পাষণ্ড না বলে কী বলা যায়! দেহেন না চেহারায় কোনো ভাবান্তর নাই। ঠান্ডা মাথার কিলার। বসেন ভাই, আপনার কাজ হবে, আগে একটু পাষণ্ড দেখে আসি।
হতভম্ব যুবককে পেছনে ফেলে ঘর ছাড়ে পুলিশের সদস্য। তার চলার পথে তাকিয়ে থাকে তাশরিফ। দেখে, দরজার পাশে দেয়ালে বাতাসে উড়ছে ক্যালেন্ডার। বাইরে দাঁড়ানো পুলিশের গাড়ি। ওটা থেকেই নামানো হয়েছে মানুষটাকে। সে এক পাষণ্ড।
তিন.
আরি থাম। আরি থাম। রহম আলীর গলায় অসহিষ্ণুতা।
কিন্তু থামার কোনো লক্ষণ নেই কুকুরটার। টাইগার তার নাম। সরাইলের গ্রে হাউন্ড নয়, মামুলি এক কুকুর। কিন্তু পড়ে থাকে থানার সামনের এই দোকানে। বেশ নির্মোহভাব তার। সারাক্ষণ মাথা নিচু করে শুয়ে থাকে। কে গেল কে এল, তাতে তার কিছু যায় আসে না। তবে দিনে তিনবার সে নিয়ম করে রহম আলীর দোকানের সামনে এসে লেজ নাড়তে থাকে। দোকান খোলার পর, দুপুরে আর দোকান বন্ধের আগে। বাকি দুই সময়ে কিছু না বললেও সকালে দোকান খুলেই টাইগারকে দেখে ভীষণ বিরক্ত হয় রহম আলী। বলে, তর জ্বালায় আর পারি না। তুই কি আমার পরিবার, তুরে খাওন না দিয়া দোকান খুলা যাবে না?
তাতে কোনো পরিবর্তন হয় না কুকুরটার। সে থাকে অপেক্ষায়। একটা রুটি কিংবা একটা বিস্কুটের। ঘেউ ঘেউ করে কম। সে জন্যই কি না তাকে কেউ ঘাঁটায় না। ঘেউ ঘেউ করা কুত্তা কদাচিৎ কামড়ায়। ঘেউ ঘেউ না করা কুত্তা কি তবে প্রায়ই কামড়ায়?
আরি থাম। আরি থাম। আমিও দেখছি। মহিলার চোখ জ্বলছিল আগুনের মতন। তাকানো যায় না। চোখের সামনে পুলিশের গাড়িতে ছিল। এমন দিনও দেখতে হইল। ও ছেমড়া যা চাইছস, তা তো পাইলি, এইবার বিদায় হ।
গাঞ্জার পুঁটলা প্যান্টের গোপন পকেটে রাখে যুবক। তাকায় লাল চোখে। বলে, একডা লাডি আছেনি ভাই, দেন কুত্তাডারে দেই মাইর। মাইরের ওপরে ওষুদ নাই।
কুত্তা তরে কী করছে। হেরে মারতে গেলে তুরেই মাইর দিমো। রেগে যায় রহম আলী।
কানের পোকা নাড়িয়ে দিল।
সে কিছু বুঝতে পারছে। ঘ্রাণে টের পাইছে একটা কিছু আছে উল্টাপাল্টা। কথা বলতে পারে না। বলতে পারলে হয়তো বলত। আমার মনে হয়, ওই মহিলারে দেইখাই ঘেউ ঘেউ করতে শুরু করে টাইগার।
জানি জানি, বলে পুলিশের ইনফর্মার। এইখানে আসার আগেই খবর পাইছি। মেয়েটার বয়স বেশি হয় নাই। সাত আট হইব। লাশ নিয়া গেছে মর্গে। কেমুন মা চিন্তা করো নিজের মেয়েরে মাইরা ফেলে। কী জানি, আরও কোনো কিছু আছে কি না? ঘটনার পেছনে কত কিছু থাকে।
কোমলপানীয় বোতল বের করে রহম আলী। একটু ঠান্ডা হোক। এই ঘটনায় অনেক সাংবাদিক না এসে থাকতে পারবে না। তাদের আপ্যায়নে কোমল পানীয়র জুড়ি নাই। এর সঙ্গে অবশ্য বিস্কুট থাকতে পারে।
টাইগার ঘেউ ঘেউ করতে থাকে।
চার.
প্রথমেই আসে একটি টিভি চ্যানেলের সাংবাদিক। এদের আসতে সময় লাগে কম। নিজস্ব গাড়িতে গান শুনতে শুনতে চলে আসে। পত্রিকার সাংবাদিকদেরও অনেকেরই মোটরসাইকেল আছে। তবে তারা প্রায়ই আসে দল বেঁধে।
তরুণ সাংবাদিকের তাড়াহুড়া অনেক। আরও কাজ আছে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার রুমে বেশিক্ষণ বসতে পারে না। খুব দ্রুত জেনে নেয় ঘটনা। আলাপচারিতার ছবি তুলে ক্যামেরাম্যান। তার অবশ্য কোনো ব্যস্ততা নেই। সংবাদ ধরানোর দায় তার না। রিপোর্টারের।
তরণীকে দেখে কিছুটা চমকে যায় রিপোর্টার। এমন গায়ের রং ঢাকা শহরের কম মেয়ের আছে। এই মেয়ে হন্তারক?
তার সামনে মাইক্রোফোন ধরে রিপোর্টার। বলে, নিজের মেয়েকে কেন খুন করলেন?
অবাক হয় মেয়েটি। তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে। বলে, কী বললেন ভাইজান। কোনো মা তার সন্তানকে মারতে পারে? পারে? অসুইখ্যা মাইয়্যা আমার। খালি রোগে ভুগে, খালি রোগে ভুগে। দুর্বল। আইজ সকাল থাইকা খালি ঘ্যান ঘ্যান করে। ঘ্যান ঘ্যান করে। বিরক্ত হইয়া একটা থাপ্পড় দিছি। মইরা গেছে। কন ভাই মা কি সন্তানরে একটা থাপ্পড় দেয় না। আদর করে আবার শাসনও করে। কোনো মা কি তার সন্তানরে হত্যা করে? আমি কিছু করি নাই, একটা থাপ্পড় কিছু না, তাতেই এত বড় ঘটনা…
ক্যামেরাম্যান অতি যত্নেমেয়েটির বক্তব্য ধারণ করে।
শেয়ার করুনঃ