কাজী রুনা
বরগুনার মেয়ে শাবনুর। ১৩ বছরের এক শান্ত-স্নিগ্ধ কিশোরীকে ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করতে হয়েছিল এ বছরের মে মাসে।
ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়ে লাঞ্ছিত নারীর আত্মহত্যার ঘটনা নতুন কিছু নয়। হরহামেশাই পত্রিকার পাতায় ছাপা হয় এরকম হাজারো ঘটনা। আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি সিমি, তৃষা, রিমার আত্মহননের ঘটনা। বখাটেদের উৎপাত সইতে না পেরে আত্মহত্যা করে পুরো জাতির বিবেককে নাড়িয়ে দিয়েছিলেন তারা।
ইভ টিজিং শব্দটির সাথে মোটামুটি সব পাঠকই পরিচিত। তবে ইভ টিজিং কী, সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট বা পরিষ্কার ধারণা অনেকেরই নেই। ইভ টিজিং একটি কাব্যিক শব্দ। ইভ অর্থে পৌরাণিক আদিমাতা হাওয়া অর্থে সমগ্র নারী জাতিকে বোঝানো হয়। কিন্তু আদতে ইভ টিজিং হচ্ছে প্রকাশ্যে যৌন হয়রানি, পুরুষ দ্বারা সংঘটিত যৌন অপরাধ। তাই বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন ইভ টিজিং শব্দটিকে আরও উপযুক্ত শব্দ দিয়ে প্রতিস্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। তাদের মতে, ইভ শব্দটি দিয়ে নারীর আবেদনময়তাকে নির্দেশ করে। যে কারণে পুরুষ স্বভাবতই আকৃষ্ট হয়, যা অনেকটাই স্বাভাবিক ঘটনা।
দেশের প্রচলিত আইনে ইভ টিজিংয়ের কোনো সংজ্ঞা নেই। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ এক রায়ে ইভ টিজিংকে যৌন হয়রানি হিসেবে বিবেচনা করে একটি আইনে অন্তর্ভুক্ত করতে আদেশ প্রদান করেছেন। সরকারি ও বেসরকারি উভয় প্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ন রোধে নীতিমালা প্রণয়ন করে হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৯ সালের ১৫ মে এ সম্পর্কে একটি রায় দেন। এ রায়ে কর্মক্ষেত্রে, শিক্ষাক্ষেত্রে এবং ঘরের বাইরে যেকোনো বয়সী নারী ও শিশু নিপীড়ন রোধে কয়েক দফা নির্দেশনা দিয়েছেন আদালত। রায়ে বলা হয়, অশোভন অঙ্গভঙ্গি, ইঙ্গিতমূলক আচরণ ও উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়া যাবে না। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে বা বাইরে উৎপাত, অশালীন ই-মেইল, ফোনে বিরক্তি, কাউকে ইঙ্গিত করে কুরুচিপূর্ণ আচরণ করা যৌন নিপীড়নের আওতায় পড়বে।
আমাদের দেশে ইভ টিজিং প্রতিরোধে আলাদা কোনো আইন নেই। তবে ইভ টিজিং প্রতিরোধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, বাংলাদেশ দণ্ডবিধি এবং ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টের ৭৫ ও ৭৬ নম্বর ধারায় কিছু বিধান রয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১০ (২) ধারায় বলা হয়েছে, কোনো পুরুষ তার যৌন কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে কোনো নারীর শ্লীলতাহানি করলে বা অশোভন অঙ্গভঙ্গি করলে তা যৌন হয়রানি বলে বিবেচিত হবে। এ ধরনের অপরাধের জন্য অপরাধী অনধিক সাত বছর এবং সর্বনিম্ন তিন বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। একই ধারায় অর্থদণ্ডেরও বিধান রয়েছে। তবে ২০০৩ সালে এই আইনের সংশোধনের মাধ্যমে ধারাটি তুলে দেওয়া হয়। তবে এই আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তির ইচ্ছাকৃত কোনো কাজ দ্বারা সম্ভ্রমহানির প্রত্যক্ষ কারণে কোনো নারী আত্মহত্যা করলে সর্বোচ্চ দশ বছর এবং সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৫০৯ এবং ২৯৪ ধারা অনুযায়ী ইভ টিজিং বা উত্ত্যক্ততা বা অশালীন অঙ্গভঙ্গি করা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। দণ্ডবিধির ৫০৯ ধারা অনুযায়ী, কেউ কোনো নারীর শালীনতার অমর্যাদা করলে বা এ ধরনের কোনো মন্তব্য বা অঙ্গভঙ্গি করলে বা বস্তু প্রদর্শন করলে ওই ব্যক্তি এক বছরের কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। তবে ইভ টিজিং প্রতিরোধে সবচেয়ে কার্যকরী ধারাটি হচ্ছে দণ্ডবিধির ২৯৪ ধারা। এখানে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি অন্যের বিরক্তি সৃষ্টি করে কোনো প্রকাশ্য স্থানে কোনো অশ্লীল কাজ করে অথবা সন্নিকটে কোনো অশ্লীল গান, গাথা-সংগীত বা পদাবলি গায়, আবৃত্তি করে বা উচ্চারণ করে সেই ব্যক্তি যেকোনো বর্ণনায় কারাদণ্ড, যার মেয়াদ তিন মাস পর্যন্ত হতে পারে অথবা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডণীয় হবে। এ আইনের বাস্তবিক প্রয়োগের মাধ্যমে সমাজে অনেকাংশেই ইভ টিজিং বন্ধ করা সম্ভব হলেও অন্যান্য আইনের মতো এর প্রয়োগে রয়েছে যথেষ্ট ঘাটতি। এ ছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অ্যাক্টের ৭৫ ও ৭৬ নম্বর ধারা অনুযায়ী, ইভ টিজিং একটি অপরাধ এবং এর জন্য শাস্তির বিধান রয়েছে। তবে শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুরুষেরা অভিনব কায়দায় ইভ টিজিং করে, যা আইনের আওতায় এনে বিচার করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ইভ টিজিংয়ের শিকার হন কিশোরীরা। এক গবেষণায় দেখা গেছে, দশ থেকে আঠারো বছর বয়সী শতকরা ৯০ জন নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। এ অবস্থা অনুধাবন করে জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের ৩৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ সকল প্রকার যৌন নিপীড়ন ও যৌন নির্যাতন থেকে শিশুকে রক্ষা করতে সচেষ্ট থাকবে। তা প্রতিরোধ করার লক্ষ্যে অংশগ্রহণকারী রাষ্ট্রসমূহ জাতীয়, দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় সকল প্রকার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।’ এ অনুচ্ছেদে অশ্লীল যৌন আচরণ বা বিষয়বস্তুতে শিশুদের অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে ও পদক্ষেপ নিতে রাষ্ট্রকে আহ্বান জানানো হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানেও নারী সুরক্ষার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। ইভ টিজিং বন্ধে বিভিন্ন নারীবাদী সংগঠন সভা-সেমিনার, মানববন্ধনের আয়োজন করে থাকেন। প্রতিবছর ১৩ জুন ইভ টিজিং প্রতিরোধ দিবসও পালিত হয়।
এত কিছুর পরও নারীর এ ধরনের যৌন হয়রানি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি। সাধারণত আইনে শাস্তির বিধান থাকা সত্ত্বেও ঘটনা ঘটলে তা আইনের আওতায় না আনায় অপরাধীরা বারবার অপরাধ করে পার পায় এবং একই ধরনের অপরাধ করতেই থাকে। তাই ইভ টিজিং নির্মূল করতে কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। ইভ টিজিংকে আইনের আওতায় এনে অপরাধীর সঠিক বিচার করলে সমাজ থেকে এ ধরনের অপরাধ নির্মূল করা সম্ভব। একই সাথে এটি বন্ধ করতে মানুষের প্রচলিত মানসিকতার পরিবর্তন প্রয়োজন। এ জন্য সবার আগে দরকার পারিবারিক ও সামাজিক সচেতনতা। এ জন্য ক্যাম্পেইন বা প্রচারকাজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে আইনের শাসন, অন্যদিকে জনসচেতনতামূলক উদ্যোগ-এ দুইয়ে মিলে সমাজ থেকে ইভ টিজিং নির্মূল করা সম্ভব।